shariakibole.com

আমেরিকায় গ্রাউণ্ডজিরো মস্ক ও শান্তির মূল্য

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে শিউরে উঠেছিল বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ, শান্তিকামী মুসলমান। জায়গাটাকে “গ্রাউণ্ড জিরো” বলা হয়, ওটার কাছে শরীফ জামাল-এর ব্যক্তিগত জায়গায় বিশাল মসজিদ ও কমিউনিটি সেণ্টার বানানোর চেষ্টা করছেন শারিয়া আইনের সমর্থক ইমাম রউফ ও তাঁর স্ত্রী। সে আইনী-অধিকার তাঁদের আছে কিন্তু তারপরেও এর পক্ষে বিপক্ষে সারা আমেরিকায় হুল¯ু ুল’ পড়ে গেছে। এর সাথে বহুকিছ ু জড়িয়ে গেছে কিন্তু আমি অন্য কথা বলবো। তার আগে বলে নিই “গ্রাউণ্ড জিরো মস্ক” শব্দটাই ভুল। দু’বক দূরে বলা হলেও জায়গাটা গ্রাউণ্ড জিরো’র কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে, ওখান থেকে গ্রাউণ্ড জিরো দেখাও যাবে না কারণ মাঝে বড়ো একটা দালান আছে। বরং সেণ্ট পল চ্যাপেল এবং চার্চ অব্ সেণ্ট পিটার তার অনেক কাছাকাছি কিন্তু ওগুলোকে “গ্রাউণ্ড চ্যাপেল” বা “গ্রাউণ্ড চার্চ” বলছে না কেউ।

যাই হোক, অসংখ্য ধর্মবিশ্বাসী-অধ্যুষিত দুনিয়ায় ব্যক্তিগত শান্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক শান্তির প্রয়োজন অসামান্য তা সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু সেটা মুফত আসে না, তার মূল্য দিতে হয়। ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে দেখা যাক আমাদের নবীজী সহ সে-মূল্য কারা কিভাবে দিয়েছেন এবং তাতে মানুষের কি লাভ হয়েছে।

১। ৬২৮ সাল। হজ্ব করার জন্য এক হাজার (দলিলভেদে ৭০০ থেকে ১৪০০) মুসলিম সাথে নিয়ে মক্কা’র উপকণ্ঠে এসে তাঁবু গেড়েছেন বিশ্বনবী। মক্কাবাসীরা তাঁকে ঢুকতে দেবে না, যুদ্ধ হয় হয় ভাব। তখন মক্কাবাসী ও তাঁর মধ্যে এক শান্তি চুক্তি হয় যা হোদায়বিয়া চুক্তি নামে বিখ্যাত। সেটা লিখছিলেন হজরত আলী, শুরু করেছিলেন “বিসমিলাে হর রহমানের রাহীম” দিয়ে। কোরেশ-প্রতিনিধি সোহেল তাতে আপত্তি করলে নবীজী সেটা বদলে শুধু “আলাহ’র নামে” লিখতে বলেন। এটা লেখার পরে লেখা হলো, “এই চুক্তি করা হলো মুহাম্মদ-উর রসুলুলাহ এবং কোরেশদের মধ্যে”। সোহেল “আলাহ’র রসুল” কথাটায় আপত্তি করলে নবীজী তা কেটে “আবদুলা’র পুত্র মুহাম্মদ” লিখতে বলেন। কিন্তু হজরত আলী তাতে রাজী হলেন না। তখন নবীজী নিজের হাতে সেটা কেটে দিলেন এবং “আবদুলা’র পুত্র মুহাম্মদ” লিখতে বললেন। এভাবে সেই শান্তিচুক্তি কার্যকর হলো, যার মধ্যে কিছু ধারা মুসলমানদের জন্য অসম্মানজনক ছিল যার জন্য প্রতিটি সাহাবী ইতিহাসে ঐ একবারই নবীজীর সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেছিলেন। তারপরেও তিনি চুক্তি মোতাবেক হজ্ব না ক’রেই ফিরে গেলেন ৫০০ কিলোমিটার দূরের মদিনায় যেখান থেকে এত কষ্ট ক’রে এসেছিলেন। মরুভূমিতে এক হাজার কিলোমিটার চলা কম কথা নয়। এত যুদ্ধের পরেও নবীজী শুধু মুখের কথায় নয় দলিলের প্রমাণে ইসলামের দু-দু’টো মূল বাক্যের মূল্য দিলেন এবং কোরেশদের অন্যায় দাবী মেনে নিলেন। ফলে কি হলো ? পরের বছর তিনি তিন হাজার মুসলিম নিয়ে বিনা যুদ্ধে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করলেন (সেদিন বিশেষ অপরাধের জন্য যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল তাদের চারজন ক্ষমাও পেয়েছিল)। এরই নাম নেতৃত্বের প্রজ্ঞা। কাবা’য় আরাধনা-ইবাদতের অধিকার আরবের প্রতিটি সম্প্রদায়ের ছিল, মুসলমানদেরও ছিল। কিন্তু অধিকার কখন কোথায় খাটাতে হয় এবং কখন কোথায় খাটাতে হয় না তা তিনি জানতেন।

২। ১৫৮৮ সাল। ভারতের শিখদের ধর্মগুরু অর্জুনদেব। আমাদের যেমন কাবা শরীফ, ক্যাথলিকদের যেমন ভ্যাটিক্যান, শিখদের তেমনি স্বর্ণমন্দির। সেটা বড়ো ক’রে বানানো হচ্ছে। গুরু’র আদেশ এলো − “লাহোর থেকে মুসলিম সুফি শেখ মিয়া মীরকে নিয়ে এসো, তাঁর হাতে এই স্বর্ণমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে।” সবাই অবাক। কেন তা হবে ? আমাদের সর্বোচ্চ গুরু বেঁচে থাকতে আমাদের সর্বোচ্চ উপাসনালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর অন্য ধর্মের লোকের হাতে হবে কেন ? গুরু’র আদেশ এলো, “যা বলছি করো। ভবিষ্যতের মানুষকে ধর্মীয় ভক্তির শক্তিতে ধর্মীয় বিভক্তিকে অতিক্রম ক’রে যাবার পথ দেখিয়ে যাব আমরা।” এক ধর্মের কেন্দ্রীয় উপাসনালয় আজো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে অন্য ধর্মবিশ্বাসীর হাতে স্থাপিত ভিত্তিপ্রস্তরের ওপরে, এ-নিয়ে বিশ্বাসীরা তর্ক করতে পারেন কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে এই হলো নেতৃত্বের অতুলনীয় প্রজ্ঞা।

৩। ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২, অযোধ্যা। কিছু ধর্মোন্মাদ নেতার নেতৃত্বে ধর্মোন্মাদ হিন্দুর দল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো ৪৭৬ বছরের ঐতিহ্যবাহী বাবরী মসজিদ। ওটা নাকি মন্দির ভেঙে বানানো হয়েছিল, ওখানে তারা আবার মন্দির বানাতে চায়। পরের বছরগুলোতে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় খুন হলো হাজারো নিরপরাধ মানুষ, প্রধানতঃ মুসলিম। উজাড় গ্রাম, জ্বলন্ত ঘরবাড়ী, অসংখ্য বিধবা আর এতিমের আর্তনাদে কেঁপে উঠলো ভারতবর্ষ। ২০০২ সালের ৩রা মার্চে হিন্দুস্তান টাইম্স্জ নমত জরীপ করলো ওখানে জনতা মন্দির চায় নাকি মসজিদ। শতকরা ৬৯.১৩ জন জানিয়ে দিলেন মসজিদটা যদি মন্দির ভেঙে বানানো হয়েও থাকে তবু এত রক্তারক্তি ক’রে মানুষ খুন ক’রে মন্দির বানাবার কোনো দরকার নেই, মসজিদের জায়গায় মসজিদই থাকুক। এরই নাম ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, এরই নাম আলোকিত মানস যা আজকের ধর্মীয় হিংস্রতার প্রেক্ষাপটে অবিশ্বাস্য মনে হবে।

আইনি অধিকারের চেয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেক বড় ব্যাপার এবং প্রজ্ঞার সাথে সেই অধিকার প্রয়োগ করাটাই সঠিক নেতৃত্ব। গ্রাউণ্ড জীরো মস্ক-এর জনমত জরীপে আমরা কি দেখি ? নয়-এগারোর মুসলিম ভুক্তভোগী সহ অন্যান্য মুসলিম, মুসলিম সংগঠন (যেমন সেণ্টার র্ফ ডেমোক্রেসি অ্যাণ্ড হিউম্যান রাইট্স্ ইন সৌদি অ্যারাবিয়া সংগঠনের ডঃ আলী আলিয়ামী) সহ শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ আমেরিকান এবং শতকরা ৬১ ভাগ নিউ ইয়র্কবাসী এর বিরোধীতা করেছেন (সি.এন.এন. ১৭ই আগষ্ট ২০১০)। মুসলিম-অমুসলিমের এই বিপুল জনমত উপেক্ষা ক’রে শুধুমাত্র আইনি শক্তিতে এগুলে সমাজ অবধারিতভাবে ঘৃণাভিত্তিক সামাজিক বিভক্তির মধ্যে পড়বে বুঝেই মরিয়া হয়ে ঐ জায়গার বদলে সরকারী অন্য জায়গা দেবার প্রস্তাব করেছেন নিউ ইয়র্কের গভর্নর ডেভিড পিটারসন। কিন্তু সেটা প্রত্যাখ্যান ক’রে ইমাম রউফ জাতিকে ঠেলে দিয়েছেন সংঘর্ষের পথে।

গ্রাউণ্ড জিরো হলো গণহত্যার জায়গা, বিশ্বের শুভবুদ্ধির অশ্র“র জায়গাগুলোর অন্যতম। নিউ ইয়র্কে ৩০টি মসজিদ তো আছেই, ঠিক ঐ স্পর্শকাতর জায়গায় আরেকটা মসজিদ বানিয়ে অধিক কি লাভ হবে যা অন্য মসজিদে হবে না ? পশ্চিমা দেশে জনমতের দেশ। এভাবে জাতিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড় করালে চাকরি ব্যবসা থেকে শুরু ক’রে বিভিনড়বধরনের মুসলিম-বিরোধী সন্ত্রাস হবে, তার দায় নেবেন এইসব গোঁয়ার মুসলিম নেতারা ? নেবেন না। তাঁরা বুঝতে চান না এই সঙ্ঘাত ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ হতে পারে, এর মধ্যেই নিউ ইয়র্কে এক বাংলাদেশী ট্যাক্সী ড্রাইভার মারাত্মকভাবে ছুরিকাহত হয়েছেন শুধুমাত্র মুসলমান হবার কারণে (ক্যানাডা বিডি নিউজ ২৮ আগষ্ট)। শারিয়া আইনের মতো ইসলাম-বিরোধী নারী-বিরোধী আইনের যাঁরা ঘোর সমর্থক সেই ইমাম রউফ এবং তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে অধিকার বনাম প্রজ্ঞার ভারসাম্য আশা করা বৃ া। যাঁকে পুলিশ ১৯৯৪ সালে গ্রেপ্তার করেছিল বেশ্যা-সংশিষ্ট ঘটনায়, যাঁর ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনা আছে, হিংস্র স্বভাবের যিনি অন্যকে মারপিট ক’রে মামলায় পড়েছিলেন, ক’বছর আগের রেস্টুরেণ্ট ওয়েটার বর্তমানে বিলিয়ন ডলারের মালিক সেই শরীফ জামাল হঠাৎ জেগে উঠে বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধারে সালাউদ্দীনের মতো প্রবলবেগে ইসলাম উদ্ধারে অবতীর্ণ হবেন, তাঁর জমিতে মসজিদ উঠে সাম্প্রদায়িক শান্তি আনবে এসব আষাঢ়ে গালগল্পের ঠকবাজীতে ভোলার জাতি আমেরিকা নয়।
http://www.thedailybeast.com/blogs-and-stories/2010-08-30/sharif-elgamal-and-the-ground-zero-mosque/?cid=hp:mainpromo2

মুখমিষ্টি কথায় ইণ্টারফেথ ডায়ালগের জন্য আমাদের কিছু ইসলামী নেতাদের তৎপরতার অভাব নেই অথচ তাঁদের হঠকারী ইণ্টারফেথ অ্যাকশন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে চরমভাবে নষ্ট করে। এর সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক নাচুনে বুড়িদের সামনে ঢোলের বাড়ি দেবার লোকেরও অভাব নেই। এর মধ্যেই কথা উঠে গেছে মক্কা মদীনাতে মন্দির-গীর্জা বানাতে দিলে তবেই এখানে মসজিদ বানাতে দেয়া হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। দাবীটা যদিও বৈধ তবু এই পরিস্থিতিকে সেটা আরো জটিল ক’রে তুলবে।

আমাদের মুসলিম পরিচিতি, ভাবমূর্তি ও অধিকার কোনো গোঁয়ার নেতৃত্বের খেলার পুতুল নয় ! দালানের বিনিময়ে সাম্প্রদায়িক শান্তি বিক্রী করার মূর্খতা আমরা কেন করবো। যে দালান রাজনৈতিক দাবাখেলার বোড়ে, যাকে একটা জাতির ৭০% নাগরিক অভিশাপ দেবে তা ইসলামী হতে পারে না। কোরাণ-রসুলেও আমরা দেখি সব মসজিদ ইসলামী মসজিদ নয়। সে-জন্যই আলাহ্তাঁ র রসুলকে অনৈসলামিক মসজিদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন (সুরা তওবা আয়াত ১০৭) এবং নবীজী সেই মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন (মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত কোরাণ, পৃঃ ৫৯২)।

এই মসজিদ বানানোর বিরোধীতা করার জন্য রক্ষণশীল মুসলিমেরা প্রগতিশীল মুসলিমদেরকে ইসলাম-বিরোধী বলেন, অন্যান্য বাহানাতেও সর্বদাই বলেন। কিন্তু প্রগতিশীলদের প্রাণান্ত চেষ্টাতেই মুসলিম সমাজ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে এবং রক্ষণশীলেরাও ধীরে ধীরে চোখ খুলছেন। বাংলাদেশের শাহ্ আবদুল হানড়বানের মতো জামাতী ও শারিয়া-তত্ত্বগুরুও এখন মুরতাদ হত্যা বা স্ত্রী প্রহারের শারিয়া আইনের বিরোধী। গ্রাউণ্ড জিরো মস্ক-এর ব্যাপারে খোদ জামাতের মতামত দেখুন তার দলীয় পত্রিকা “দৈনিক সংগ্রাম”-এর ২৬ আগষ্টের সম্পাদকীয়তে (সারাংশ) ঃ

“গ্রাউণ্ড জিরোতে ইসলামিক সেণ্টার ও মসজিদ নির্মাণের সপক্ষে বক্তব্যদাতাদের উচিত বিষয়টির ব্যাপারে প্রতিপক্ষের যে ভুল ধারণা রয়েছে সেই ভুলের অপনোদন করা। কেননা তাদের উপরোক্ত বক্তব্য থেকে মুসলমানদের ব্যাপারে যে মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে, সেটা দূরীকরণ না হওয়া পর্যন্ত পরিবেশকে স্বাভাবিক বলা যাবে না। আর ঐ পরিস্থিতিতে সেখানে কিছু করা হলেও ইসলামের কল্যাণ কতদূর হবে তা প্রশড়ববিদ্ধ … মুসলমানদের এমন কোনো জেদের আশ্রয় নেয়া সঙ্গত নয়, যা ইসলামের লক্ষ্যের জন্য অশোভনীয় হবার সম্ভাবনা থাকে।”

আমিও হুবহু ঠিক ঐ কথাই বলছি। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সাম্প্রদায়িক শান্তি বিশাল ব্যাপার কিন্তু ইণ্টারফেথ অ্যাকশন দিয়ে তার মূল্য দিতে হয় যা নবীজী ও অন্যান্য নেতারা দিয়েছিলেন। জনগণ তো বোকা নয়, সে মূল্য না দিলে জাতির চোখে ইণ্টারফেথ ডায়ালগ শুধুমাত্র মুখমিষ্টি কথার ঠকবাজী হয়েই চিহ্নিত হবে। চালাকি ধূর্তামি দিয়ে কোনোদিনই সমাজের মঙ্গল করা যায়নি, যাবেও না ॥