shariakibole.com

ইসলাম কি, মুসলমান কে

যেকোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রমেই সেটা কাকে বলে তা ঠিক করতে হয়। তাতে আলোচনার সুবিধে হয়। ইসলাম কি আর মুসলমান কে তা ঠিক করতে পাকিস্তানে ১৯৫৩ সালে মুনির কমিশন মওলানা মওদুদি সহ দেশের সর্বোচ্চ ৭ জন মওলানার সাথে আলোচনা করেছিলেন দীর্ঘ দু’বছর ধরে। শেষ পর্যায়ে এসে কমিশন রিপোর্ট দিয়েছিল, (সারাংশ) মুসলমান কাকে বলে সেব্যা পারে প্রত্যেক মওলানার মতামত এতই আলাদা যে এঁদের কেউ কোন ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হলে বাকি সবাইকে মুরতাদ হিসেবে কলা কেটে ফেলবেন (মুনির কমিশনের রিপোর্ট পৃষ্ঠা ২১৬, লিগ্যাল সাইজ)। অর্থাৎ কে মুসলমান সেটাই ঠিক করা গেল না কিন্তু কে মুসলমান নয় সেই হুঙ্কারে চোদ্দশ’ বছর ধরে রক্তস্রোতে কেঁপেছে মুসলিম-বিশ্ব, কাঁপছে বাংলাদেশ।

কিন্তু মওলানারা যা জানতেন না বা নিজেরা জানলেও জাতিকে জানাতে চাননি তা বিখ্যাত জিব্রাইলের হাদিসে বলে গেছেন পয়গম্বর (সাঃ) নিজে – (উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) কতৃর্ক বণির্ত ) − “একদিন হজরত জিব্রা ইল মানুে ষর বেশে নবীজীর কাছে আসিলেন এবং বলিলেন, হে নবী। ইসলাম কাহাকে বলে ?” তিনি বলিলেন, “ইসলাম হইল, তুমি আলাহ্ ’র ইবাদত করিবে এবং কাহাকেও শরিক করিবে না, নামাজ প্রতিষ্ঠা করিবে, জাকাতকে ফরজ হিসাবে পালন করিবে” (সহি বুখারি ও মুসলিম, ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৭৩৩, নোট ১, এবং মিশকাতুল মাসাবিহ্ ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ২৩-২৫, নং ২(১)-এর সূত্রে বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৪৯৮)। একই প্রমাণ দেখুন হাদিস কুদসি থেকে ঃ আন্ নাবাবীর ফর্টি হাদিস −

HADITH 2
Also on the athority of ‘Umar (may Allah be pleased with him), who said : One day while we were sitting with the Messenger of Allah (may the blessings and peace of Allah be upon him) there appeared before us a man whose clothes were exceedigly white and whose hair was exceedingly black; no signs of journeying were to be seen on him and none of us knew him. He walked up and sat down by the Prophet (may the blessings and peace of Allah be upon him). Resting his knees against his and placing the palms of his hands on his thighs, he said: O Muhammad, tell me about Islam. The Messenger of Allah (may the blessings and peace of Allah be upon him) said: Islam is to testify that there is no god but Allah and Muhammad is the Messenger of Allah, to perform the prayers, to pay the zakat, to fast in Ramadan, and to make the pilgrimigate to the House if you are able to do so. He said: You have spoken rightly, and we were amazed at him asking him and saying that he had spoken rightly.

এবারে দেখা যাক আবদুল করিম খান সম্পাদিত হাফেজ আবদুল জলিলের বাংলা অনুবাদ, পৃষ্ঠা ৩৯ হাদিস নম্বর ১২। লম্বা হাদিস, মাঝখান থেকে তুলে দিচ্ছি ঃ “আবদুলা কায়েস নামক গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল … আরজ করিল − ইয়া রসুলুলাহ্ ! … আপনি আমাদিগকে কয়েকটি স্পষ্ট উপদেশ ও আদেশ নিষেধ বলিয়া দিন যাহা অনুসরণ করিয়া আমরা সকলে বেহেশ্ত লাভের উপযুক্ত হইতে পারি। … রসুলুলাহ্ (দঃ) প্র মতঃ তাহাদিগকে চারিটি কর্তব্যের আদেশ করিলেন। (১) … কায়মনোবাক্যে এই অঙ্গীকার ও স্বীকারোক্তি করা যে একমাত্র আলাহ্ ই মা’বুদ, আলাহ্ব্য তীত অন্য কোন মা’বুদ নাই এবং মোহাম্মদ (দঃ) আলাহ্ ’র রসুল। (২) নামাজ উত্তমরূপে আদায় করা, (৩) জাকাত দান করা, (৪) রমজান মাসে রোজা রাখা এবং গণিমতের মালের এক পঞ্চমাংশ দেওয়া। রসুলুলাহ্ (দঃ) তাহাদিগকে চারিটি বস্তু (পাত্র) ব্যবহার করিতে নিষেধ করিলেন। রসুলুলাহ্ (দঃ) তাহাদিগকে ইহাও বলিলেন, এই সব আদেশ নিষেধকে তোমরা ভালরূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়া লইবে এবং দেশে গিয়া সকলকে ইহা জানাইয়া দিবে।”

এই হলো ইসলাম, – বেহেশ্ত লাভের উপযুক্ত, এর মধ্যে না আছে ফতোয়া, না আছে শারিয়া-আইন বা রাষ্ট্র। এরই সমর্থন আমরা দেখতে পাই কোরাণে, নবীজীর জীবনীতে, আমাদের ইমামদের মধ্যে আর ইসলাম প্রচারকদের মধ্যে। নবীজী কেন বলেছিলেন যারা অনুপস্থিত তাদের “সকলকে ইহা জানাইয়া দিবে ?” কারণ, ওটাই হল ইসলাম। এ-নির্দেশ চিরকালের মুসলিমের জন্যও, আমাদের জন্যও। সমাজ চালানোর জন্য তাঁকে যে-সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সেগুলোকে কিন্তু তিনি কখনোই বলেননি “সকলকে ইহা জানাইয়া দিবে।” এভাবেই তিনি এ-সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন যে, কোন একসময়ের কোন একসমাজের শাসন-ব্যবস্থা ইসলামি ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ নয়। এর সাথে চমৎকার মিল রেখে আলাহ্প রিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর রসুলদেরকে −

“সুসংবাদ দাতা ও ভীতিপ্রদর্শক ব্যতীত (অন্য কোন কাজে) আমি পয়গম্বর প্রেরণ করি না” (আল আনা’ম, আয়াত ৪৮)। এর সাথে আমাদের এ-দাবিও মিলে যায়, হজরত আদম থেকে নবীজী পর্যন্ত ইসলাম আগাগোড়া ধারাবাহিক অবিচ্ছিনড়ব একই ধর্ম কারণ কোরাণ সব নবীদের হুবহু একই দায়িত্ব দিয়েছে সুস্পষ্ট ভাষায়। সেটা হল − সুসংবাদ দাতা ও ভীতিপ্রদর্শক। এমনকি হজে¦র মতো ফরজ ইবাদতের ক্ষেত্রেও আলাহ সুস্পষ্ট ভাষায় হজরত ইব্রাহীমকে বলেছেন “তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা করা, আমার দায়িত্ব দুনিয়াময় পৌঁছানো” বাংলা কোরাণ, মুহিউদ্দিন খান, পৃষ্ঠা ৮৯৯।

আমাদের নবীজীর এই একই দায়িত্ব দেখে নিন সৌদি আরব থেকে প্রকাশিত মওলানা মুহিউদ্দীনের কোরাণের বাংলা অনুবাদ থেকে। সেই সাথে আমরা এ’ও দেখব মওলানা মওদুদি তাঁর বিশাল কেতাব তাফহিমুল কুরাণে প্রতিটি আয়াত ধরে ধরে কোরাণের ব্যাখ্যা দিলেও এই অতি গুরুত্বপূর্ণ আয়াতগুলোর ব্যাপারে কি বলেছেন।

১। আল আনা’ম ৪৮। “সুসংবাদ দাতা ও ভীতিপ্রদর্শক ব্যতীত (অন্য কোন কাজে) আমি পয়গম্বর প্রেরণ করি না।” কোন মন্তব্য না করে মওলানা মওদুদি নিঃশব্দে পরের আয়াতে চলে গেছেন।

২। আল গাসিয়াহ ২১ ও ২২। “অতএব, আপনি উপদেশ দিন, আপনি তো কেবল একজন উপদেশ দাতা, আপনি তাহাদের শাসক নহেন।” কোন মন্ত ব্য না করে নিঃশব্দে মওদুদি পরের আয়াতে চলে গেছেন।

৩। ইউনুস ১০৮। “বলিয়া দাও, হে মানবকুল, সত্য তোমাদের নিকট পৌঁছাইয়া গিয়াছে তোমাদের পরওয়ারদিগারের তরফ হইতে। এখন যে কেহ পথে আসে সে পথ প্রাপ্ত হয় স্বীয় মঙ্গলের জন্য। আর যে বিভ্রান্ত অবস্থায় ঘুরিতে থাকে সে স্বীয় অমঙ্গলের জন্য বিভ্রান্ত অবস্থায় ঘুরিতে থাকিবে। অনন্তর আমি তোমাদের উপর অধিকারী নহি।” কোন মন্তব্য না করে মওদুদি নিঃশব্দে পরের আয়াতে চলে গেছেন।

৪। আল্-মায়েদাহ্ ৯২ এবং ৯৯। “কিন্তু যদি তোমরা বিমুখ হও, তবে জানিয়া রাখ, আমার রসুলের দায়িত্ব প্রকাশ্য প্রচার ছাড়া কিছু নহে” … “রসুলের দায়িত্ব শুধু পৌঁছাইয়া দেওয়া।” কোন মন্তব্য না করে মওদুদি নিঃশব্দে পরের আয়াতে চলে গেছেন।

৫। নাহল ৩৫। “রসুলের দায়িত্ব তো শুধুমাত্র সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছিয়ে দেয়া।” কোন মন্তব্য না করে মওদুদি নিঃশব্দে পরের আয়াতে চলে গেছেন।

৬। আশ শুরা ৪৮। “যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আপনাকে আমি তাদের রক্ষক করে পাঠাইনি। আপনার কর্তব্য কেবল প্রচার করা।” কোন মন্তব্য না করে মওদুদি নিঃশব্দে পরের আয়াতে চলে গেছেন।

৭। হির্জ ৮৯। “বলুন, আমি প্রকাশ্য ভয় প্রদর্শক।” কোন মন্তব্য না করে মওদুদি নিঃশব্দে পরের আয়াতে চলে গেছেন।

৮। আরাফ ১৮৪। “তিনি তো ভীতি প্রদর্শনকারী প্রকৃষ্টভাবে।” কোন মন্তব্য না করে মওদুদি নিঃশব্দে পরের আয়াতে চলে গেছেন।

৯। নাহল ৮২। “অতঃপর তাহারা যদি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, তবে আপনার কাজ হইল সুস্পষ্টভাবে পৌঁছাইয়া দেওয়া।” মওদুদি কিছুই না বলে পরের আয়াত ৮৩-এর ব্যাখ্যায় চলে গেছেন।

১০। কাহ্ফ ৫৬। “আমি রসুলদিগকে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী রূপেই প্রেরণ করি।” মওদুদি বলেছেন − “বিচারের আগে আত্মসমর্পণের কল্যাণ ও অবাধ্যতার অকল্যাণ সম্বন্ধে লোকদিগকে আগে হইতে হুঁশিয়ার করার জন্য (ভড়ৎবধিৎহ) আমি আমার রসুলদিগকে প্রেরণ করি।” ১১। আল আহযাব ৪৫। “হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদ-দাতা এবং সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করিয়াছি।” লম্বা মারিফতি ব্যাখ্যা দিয়েছেন মওদুদি, কোন আইন-কানুন বা রাষ্ট্রের কথা নেই।

১২। আল আনাম ১০৭। “আমি আপনাকে তাহাদের সংরক্ষক করি নাই এবং আপনি তাহাদের কার্য্যনির্বাহী নহেন।” মওদুদি বলেন − “নবী (দঃ)-এর কাজ ছিল শুধুমাত্র সত্য প্রচার করা এবং মানুষকে ইহা গ্রহণে আহ্বান করা। ইহাতেই তাঁহার দায়িত্ব শেষ হইয়া যায় কারণ তিনি আর যাহা হৌক মানুষের শাসক (ডধৎফবহ) নহেন।” তাহলে ? ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্ব কি করে ইসলামী ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ হল ?

১৩। কাহ্ফ ২৯। “বলুন, সত্য তোমাদের পালনকর্তা হইতে আগত। অতএব, যাহার ইচ্ছা বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যাহার ইচ্ছা অমান্য করুক।” মওদুদি লম্বা ব্যাখ্যা দিয়েছেন − কোন আইন-কানুন বা রাষ্ট্রের কথা বলেননি।

১৪। আল-আহ্ক্বাফ ৯। “বলুন,…আমি স্পষ্ট সতর্ককারী ব্যতীত আর কিছুই নহি।” মওদুদি বলেছেন − “নবীজীর একমাত্র দায়িত্ব হইল মানুষের সামনে সত্যপথ তুলিয়া ধরা ও যাহারা তাহা প্রত্যাখ্যান করে তাহাদিগকে সাবধান করা।” তাহলে? ইসলামী রাষ্ট্রতত্ব কি করে ইসলামী ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ হলো ?

১৫। নিসা ৮০। “আর যে লোক বিমুখ হইল, আমি আপনাকে (হে মুহম্মদ! তাহাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করি নাই।” মওদুদি বলেছেন − “নবীজীর একমাত্র দায়িত্ব হইল আলাহ্’র আদেশ-নির্দেশকে মানুষের কাছে পৌঁছাইয়া দেওয়া, মানুষকে সত্যপথে বাধ্য করা তাঁহার দায়িত্ব নহে।”

১৬। সুরা তওবা ৫১। “তিনি (আলাহ্) আমাদের কার্যনির্বাহক।” লম্বা ব্যাখ্যা দিয়েছেন মওদুদি − কিন্তু কোন আইন-কানুন বা রাষ্ট্রের কথা নেই।

১৭। বাকারা ১১৯। “নিশ্চয় আমি আপনাকে সত্য ধর্মসহ সুসংবাদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শনকারী রূপে পাঠিয়েছি।” মওদুদি এখানে স্থানীয় অমুসলিমদের দাবীর কথা টেনে এনেছেন, − সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে।

১৮। বাকারা ২৭২। “তাদেরকে সৎপথে আনার দায় তোমার নয়।” কথাটা তো বলা হয়েছে স্বয়ং নবীজীকেই, সাধারণ মুসলমানদেরকে নয়। কিন্তু মওদুদি বলেন − “এই আয়াতের অর্থ হইল মুসলমানেরা অন্যদিগকে সত্য পথের নির্দেশ জোর করিয়া গ্রহণ করিতে বাধ্য করিবে না।” জোর করার কথাটা কোত্থেকে এল ?

১৯। নিসা ১৬৫। “সুসংবাদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শনকারী রসুলগণকে পাঠিয়েছি।” মওদুদি একই কথা বলেন।

২০। আনাম ৫২। “তাদের হিসাব বিন্দুমাত্র আপনার দায়িত্বে নয়।” মওদুদি একই কথা বলেন।

২১। আনাম ৬৬। “আপনি বলে দিন, আমি তোমাদের উপর নিয়োজিত নই।” মওদুদি বলেন − “নবীর কর্তব্য হইল শুধুমাত্র সত্য হইতে মিথ্যাকে স্পষ্টভাবে পৃথক করিয়া ঘোষণা দেওয়া।”

২২। রা’দ ৪০। “আপনার দায়িত্ব তো পৌঁছে দেয়া, আমার দায়িত্ব হিসাব নেয়া।” মওদুদি এখানে স্থানীয় অমুসলিমদের দাবীর কথা টেনে এনেছেন, যেটা সম্পূর্ণ অন্য বিষয়।

২৩। ছোয়াদ ৬৫। নবীজী বলছেন − “আমি একজন সতর্ককারী মাত্র।” মওদুদি একই কথা বলে একে সমর্থন করেছেন

২৪। ছোয়াদ ৭০। নবীজী বলছেন − “আমি একজন স্পষ্ট সতর্ককারী।” মওদুদি একই কথা বলে একে সমর্থন করেছেন

২৫। ফাতির ২৩ ও ২৪। “আপনি তো কেবল একজন সতর্ককারী। আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে।” মওদুদি বলেছেন − “আপনার একমাত্র কর্তব্য হইল লোকসকলকে সতর্ক করা। ইহার পরে কেউ না বুঝিয়া বিপথগামী হইলে সেজন্য দায়ী নহেন কারণ অন্ধকে দেখাইবার বধিরকে শুনাইবার দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হয় নাই।

২৬। ফুরকান ৫৬। “আমি আপনাকে সুসংবাদ ও সতর্ককারীরূপেই প্রেরণ করেছি।” মওদুদি বলেছেন ঃ “বাণী পৌঁছাইবার পর তাঁহার কর্তব্য ও দায়িত্ব শেষ হইয়া যায়, ইহার পর সবকিছু তোমাদের ও তাঁহার (আলাহ’র − লেখক) মধ্যেকার বিষয়।”

২৭। বাকারা ২৫৩-এর ব্যাখ্যাতে তিনি বলেছেন ঃ “মানুষকে জোর করিয়া বিশ্বাসী ও অনুগত করিবার জন্য আলাহ নবীরসুলেক পুলিশ করিয়া পাঠান নাই। বরং তিনি তাঁহাদিগকে পাঠাইয়াছেন মানুষকে যুক্তিসঙ্গত কথা ও সুস্পষ্ট প্রমাণ দিয়া সঠিক পথে আনিতে।”

অর্থাৎ মওদুদির মত নেতাও এই অতি গুরুত্বপূর্ণ আয়াতগুলোকে হয় নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে চলে গেছেন, অথবা সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছেন, নয়ত এমন ব্যাখ্যা করেছেন যা বিষয়ের সাথে মেলে না − কিন্তু বিরোধীতা কোথাও করতে পারেননি। হজরত নূহ, হজরত হুদ, হজরত সালেহ ও হজরত শোয়েব-এর প্রতি এই একই দায়িত্ব দেখে নিন সুরা আল আরাফ, আয়াত ৬১, ৬২, ৬৭, ৬৮, ৭৯ ও ৯৩ থেকে। এঁরা কেউ কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি। হজরত সুলায়মান (আঃ) বংশগতভাবে নবী ছিলেন, হজরত ইউসুফ (আঃ)-কে মিশরের রাজা সিংহাসন দিয়েছিলেন, এবং হজরত দাউদকে বনি ইসরাইলদের রাজা তালুত কন্যা ও রাজ্য দিয়েছিলেন (কাসাসুল আম্বিয়া ২য় খণ্ড)। বহু নবী ব্যাপকভাবে সমাজের বিচার- আচারও করেননি, যেমন হজরত ইয়াকুব (আঃ), হজরত জাকারিয়া (আঃ), হজরত ইউনুস (আঃ), হজরত ইয়াহিয়া (আঃ), হজরত লূত (আঃ), হজরত শোয়েব (আঃ), হজরত নূহ (আঃ), হজরত ঈসা (আঃ), ইত্যাদি। কিন্তু তাই বলে তাঁরা কি নবী ছিলেন না ? অবশ্যই ছিলেন।

এই হল সহজ সরল ইসলাম। অথচ তারপরেও মওদুদি বলেছেন ঃ “ইসলামের নীতি ও শিক্ষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন না করা পর্যন্ত আমাদের শাহাদা (কলমা পড়া) পূর্ণ হইবে না” − ‘উইটনেস টু ম্যানকাইণ্ড’ পৃষ্ঠা ৩২। কেন হইবে না ? তাঁর মতে না মিললে সে মুসলমানই নয় ? এর সাথে তাঁর নারী-বিরোধী শারিয়া আইনের প্রতি সমর্থন, দাসপ্রা-সমর্থন (সুরা মুহম্মদ আয়াত ৪-এর ব্যাখ্যা), ভারতে হিন্দু-রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন (মুনির কমিশন রিপোর্ট) ও বন্দিনী-ধর্ষণের প্রতি সমর্থন যোগ করলে আমরা শারিয়া-রাষ্ট্রের ভয়ঙ্কর চিত্র পাই। এতে বহু মওলানা অত্যন্ত উদ্বিগড়ব হয়ে তাঁর বিরোধীতা করেছেন ও তাঁকে কাফের ও দজ্জালও বলেছেন। আপনারা ভারত-বিখ্যাত মওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদভী (লক্ষেèৗ শহরের) লিখিত পাণ্ডিত্যপূর্ণ বই “আছর-ই হাজির মে দ্বীন কি তাহফিম-ও-তাশরিহ” (বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মের উপলব্ধি ও ব্যাখ্যা) বইটা দেখতে পারেন। মওদুদির প্রতি তাঁদের আলোচনার প্রস্তাবে মওদুদি কখনো রাজি হননি।

এখানে একটা অত্যন্ত দরকারি কথা এসে যায়। “ইসলামি বিশেষজ্ঞ” আমরা কাকে বলব ? বহু কেতাব পড়লেই কি তা হওয়া যায় ? অনেকের স্মরণশক্তি খুব ভালো, তাঁরা বহু কেতাবের বহু কিছু মনে রাখতেও পারেন, গড়গড় করে বলতেও পারেন। অনেকে অনেক ইসলামি ডিগ্রীও হাসিল করতে পারেন। কিন্তু ওগুলো হলেই কি ইসলামি বিশেষজ্ঞ হওয়া যায় ? মোটেই নয়। যেমন, যারা আণবিক শক্তি দিয়ে ভয়াবহ ধ্বংসকারী বোমা আবিষ্কার করেছে তারা কি বৈজ্ঞানিক ? মোটেই নয়। বরং বৈজ্ঞানিক তাঁরাই যাঁরা আণবিক শক্তি দিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি, বন্যা-নিরোধক বাঁধ, ওষুধ, পরিবেশ-রক্ষাকারী মেশিন ইত্যাদি আবিষ্কার করে মানুষের কল্যাণ করেন। যারা অর্থনীতির বিশ্ব-পুঁজিবাদ আবিষ্কার করে মানুষকে শোষণ করে কষ্ট বাড়ায় তারা কি অর্থনীতিবিদ ? মোটেই নয়। অর্থনীতিবিদ তাঁরাই যাঁরা বহু পড়াশুনা করে পরিশ্রম করে মানব-কল্যাণের উপযোগী অর্থনৈতিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ধর্মের ক্ষেত্রেও এ-কথা সত্যি। ইসলামি বিশেষজ্ঞ শুধুমাত্র তাঁরাই যাঁরা প্রচুর পড়াশুনা করে মেধা দিয়ে ইসলাম থেকে মানুষের মঙ্গল তুলে আনেন। যার ধর্মব্যাখ্যায় মানুষের মঙ্গল না হয়ে কষ্ট বেড়ে যায় সে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ তো দূরের কথা বরং ধর্মের শত্র“, তা সে যতই বিখ্যাত হোক, যতই পড়–ক-লিখুক বা যত ডিগ্রিই থাকুক।

অর্থাৎ আমরা দেখলাম শারিয়া-ইসলামের প্রধান প্রবক্তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা মওলানা মওদুদি পর্যন্ত বারবার স্বীকার করেছেন নবীদের দায়িত্ব হল শুধুমাত্র প্রচার করা।

পয়গম্বর কথাটাই তো এসেছে পয়গাম অর্থাৎ সংবাদ শব্দ থেকে। নবীজী কি কখনো বলেছিলেন ‘আমি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই’ বা ‘আমি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম প্রচার করতে চাই ?’ খেয়াল করুন, খেয়াল করুন, আছে কোন দলিল ? নেই। বিদায় হজ্বে তাঁর শেষ বক্তৃতায়ও নেই, মৃত্যুশয্যায় শেষ বৃহস্পতিবারে দেয়া (তিনি সোমবারে দেহত্যাগ করেন) তাঁর তিনটে সর্বশেষ নির্দেশেও নেই।

আমাদের বুঝতে হবে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা নবীদের নবীত্বের কোন শর্তই নয়। ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক বা না হোক, আমাদের নবীজী কখনোই অর্ধেক বা এক চতুর্ াংশ নবী ছিলেন না। পরিপূর্ণ নবী তিনি হেরা পর্বতে প্র ম ওহি নাজিলের মুহূর্তে একা, তারপর মুসলিম সমাজ-ব্যবস্থা ছাড়াই মক্কায় অত্যাচারিত হবার তেরো বছর, তায়েফে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত সময়ে একা, মদীনায় মুসলিম সমাজ কায়েম করে সমাজ চালানোর সময়, ১৯২৪ সালে মুসলিম খেলাফত ভেঙ্গে যাবার পরে এখনও। এবং তিনি পরিপূর্ণ নবী চিরকাল, ওটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয়। এমনকি “আদমের দেহে আত্মা সঞ্চারের পূর্বেই আমি নবী ছিলাম” (পৃষ্ঠা ১৮৪ বাংলা কোরাণ মওলানা মুহিউদ্দিন)। তাহলে সামাজিক শাসন কিংবা বিচার-আচার কেন তাঁর নবীত্বের কিংবা ইসলামের ধর্মবিশ্বাসের শর্ত হবে ?

নবীজী এ-ও বলেছেন, “কোন সমস্যা সমাধানে তোমরা দুইজন ঐকমত্যে পৌঁছিলে আমি উহাতে মতানৈক্য করিব না” (বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ৩য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৮১৫)। “রসুলুলাহ (স) তাঁহার সাহাবীগণের সহিত যত অধিক পরামর্শ করিতেন অপর কাহাকেও তাহার তুলনায় অধিক পরামর্শ করিতে দেখি নাই” (২য় খণ্ডের ২৪১ পৃষ্ঠা)। নবীজী প্রায়ই বলতেন, “আমাকে পরামর্শ দাও। কারণ যে-সব বিষয়ে আমার উপর ওহী নাজিল হয় নাই সে-সব বিষয়ে আমি তোমাদের মতই” (ঐ − পৃষ্ঠা ২৪১)। এতগুলো তথ্য এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত করে যে, দেশ চালানোর পদ্ধতি ইসলামি ধর্মবিশ্বাসের অংশ নয় কারণ নবী-রসুলগণ সাধারণ মানুষের সাথে পরামর্শ করে ধর্ম ঠিক করেন না। অথচ নবীজীর প্রতিটি ব্যক্তিগত কাজ-কর্মকে সুনড়বতের নামে ইসলামি ধর্ম-বিশ্বাসের অঙ্গ বলে বিশ্ব-মুসলিমকে বিশ্বাস করানো হয়েছে। এতে তাঁর হাঁচি-কাশি, উটে চড়া, স্ত্রীকে ঘাড়ে চড়িয়ে খেলা দেখানো, যুদ্ধ করা, হাজারো হাসি-ঠাট্টা, পঙ্গপাল খাওয়া ও উটের মূত্র-পানের নির্দেশ পর্যন্ত সবকিছু ইসলামি ধর্ম-বিশ্বাসের অঙ্গ হয়ে বসে আছে।

আইন ও রাষ্ট্র যদি ইসলামি ধর্ম-বিশ্বাসের অঙ্গ হত তবে আমাদের হাদিস ও শারিয়া ইমামেরা রাজনীতি করতেন, ইসলামি রাজপ্রাসাদে যোগ দিতেন। কিন্তু রাজাদের অনুরোধ ও চাপের পরও তাঁরা প্রত্যেকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে শতহস্ত দূরে থেকেছেন। এ-ব্যাপারে পরে আলোচনা করা হল। এবার সেই শান্তি- কপোতগুলোর দিকে তাকানো যাক, যাঁরা এই বাংলার মাটিতেই যুদ্ধ করেছিলেন, জিতেছিলেন, এবং শতকরা একশ’জন অমুসলমানের মধ্যে বসবাস করে শুধু শান্তি বাণী দিয়েই শতকরা ষাট-সত্তরজনকে মুসলমান বানিয়ে ছেড়েছিলেন। তাঁদের অনেকেই ছিলেন দুর্মুখ যোদ্ধা। অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে জনগণের নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই। বিজয়ী হবার পরে অবশ্যই তাঁরা রাজা হয়ে বসে ইসলাম প্রচার করতে পারতেন। রাষ্ট্র-ক্ষমতায় বসলে ধর্ম-প্রচারে তাঁদের সবদিক দিয়ে অনেক সুবিধেই হত। কিন্তু তবু তাঁরা সুযোগ পেয়েও কখনোই রাষ্ট্র-ক্ষমতা হাতে তুলে নেননি, সারাজীবন ধরে জনগণের মধ্যে বসেই জীবনপাত করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। কেন ? কারণ তাঁরা ঠিকই বুঝেছিলেন, ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার সাথে রাষ্ট্র-ক্ষমতার সাঙ্ঘাতিক একটা মৌলিক বিরোধ আছে। নামের আগে হজরত পড়ে নেবেন, মাত্র কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি।

১। শাহ জালাল − পরাজিত করেছিলেন − গৌর গোবিন্দকে − সিলেট।
২। শাহ মাহমুদ − পরাজিত করেছিলেন − বিক্রমকেশরীকে − ?
৩। জাফর খাঁ গাজী − পরাজিত করেছিলেন − মান-নৃপতিকে − দিনাজপুর।
৪। পীর বদরুদ্দীন − পরাজিত করেছিলেন − রাজা মহেশকে − দিনাজপুর।
৫। শাহ বদরুদ্দীন − পরাজিত করেছিলেন − মগ দস্যুদের − চট্টগ্রাম।
৬। সুলতান বলখী − পরাজিত করেছিলেন − রাজা বলরামকে − হরিরামপুর।
সুলতান বলখী − পরাজিত করেছিলেন − পরশুরামকে − বগুড়া।
৭। কাত্তাল পীর − পরাজিত করেছিলেন − মগ দস্যুদের − চট্টগ্রাম।
৮। বড়খাঁ গাজী − পরাজিত করেছিলেন − মুকুট রায়কে − যশোহর।
৯। শাহ নেকমর্দান − পরাজিত করেছিলেন − ভীমরাজকে − দিনাজপুর।

এঁদের মধ্যে কে রাজা হয়ে বসেছিলেন ? কেউ না, এ-ক-জ-ন-ও না। রাষ্ট্রের গদিতে বসা-ই যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় হয় তাহলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়াতে কে রাজনীতির ষড়যন্ত্র করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছে ? কোন্ সে খ্রীষ্টান রাজ্যের মহাসম্রাট হয়ে সুউচ্চ তখ্তে বসেছিলেন যীশুখ্রীষ্ট ? কোন্ সে ইহুদী রাজ্যের মহাসম্রাট হয়ে সুউচ্চ তখ্তে বসেছিলেন হজরত মুসা ? কোন্ সে বৌদ্ধ-সাম্রাজ্যের মহাসম্রাট হিসেবে সুউচ্চ সিংহাসনে বসেছিলেন গৌতম বুদ্ধ ? কোন্ সে শিখ-সাম্রাজ্যের স্বর্ণসিংহাসনে বসেছিলেন গুরু নানক ?

কেন, দুনিয়া জুড়ে প্রতিষ্ঠা হয়নি ইহুদী-খ্রীষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্ম ? প্রতিষ্ঠিত হয়নি শিখ ধর্ম ? আমাদের বাংলায় কে এসে রাজত্ব করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছে ? শুধু বাংলা কেন, মাত্র একটা উদাহরণ দেখান পৃথিবীর ইতিহাস থেকে যেখানে কোন ধর্ম- প্রচারককে শুধু ধর্মের প্রতিষ্ঠার জন্য সিংহাসনে বসতে হয়েছে। দেখাতে পারবেন না, কোন ধর্ম-প্রচারকই তা করেননি। ইতিহাসের শিক্ষা বরং তার উল্টো। সুবিশাল ভারতবর্ষের পরাক্রমশালী বাদশাহ আকবরের দ্বীন-এ-এলাহী উড়ে গেছে কালের হাওয়ায়, কিন্তু গ্রামের পথে পথে খালি পায়ে ঘোরা শ্রী চৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্ম ঠিকই টিকে আছে, টিকে আছে পাবনার অনুকূল ঠাকুরের এত ছোট সৎসঙ্গ ধর্মও। জমিদারের ছেলে গৌতম বুদ্ধ আর মহাবীর রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পথে নেমেছিলেন বলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম।

আমেরিকার ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষিয়ান ইসলামি বিশেষজ্ঞ ডঃ আবদুল আজিয সাচেদিনার মধ্যে হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার রাখিবন্ধন। তাঁকে আমি চিঠিতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইসলামি রাষ্ট্র ইসলামের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ কি না। জবাবে তিনি লিখেছেন ঃ

প্রিয় হাসান,
সালাম। না, ইসলামি “রাষ্ট্র”-এর তত্ত্ব ইসলামি ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ নয়। ইমানের দাবি হল, জনগণের জন্য ন্যায় ও সাম্যের জন্য কাজ করা। দারুল ইসলাম ও দারুল হর্ব-এর তত্ত্ব আমরা জানি। এ-দু’টোর কোনটাই কোরাণ-হাদিসে নেই, এগুলো ফিক্হ্-এর অংশ। তাক্ওয়া নিয়ে বাঁচা এবং পৃথিবীর যে কোন জায়গায় ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করাই হল ইসলাম। – আ. এস.। এই একই কথা বলেছেন অতীত-বর্তমানের শত শত ইসলামি বিশেষজ্ঞও ।

ইসলাম কি তা আমরা কোরাণ-রসুল থেকে পেয়েছি। এখন দেখা যাক কে মুসলমান। আজকাল বহু ইসলামি নেতার মুখে শোনা যায় এ কাফের ও কাফের। আপনি যে-ই হোন না কেন কোনো না কোনো মওলানার মতে আপনি কাফের হবেনই। এই মওলানারা বোঝেন না যে তিনি অন্য মুসলমানকে কাফের বলছেন, তাঁকে কাফের বলারও মওলানা আছে। তাঁদের বোঝা দরকার মুসলমান হওয়াটা জীবনে বিশাল ব্যাপার। নিজের ব্যাপারে এই বিশাল ব্যাপারের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হয়, সে অধিকার কোনো মানুষের হাতে দেয়া যায় না কারণ মানুষ ভ্রান্তিময়। যে ভ্রান্তিময় আমরা আজ মরলে কাল আমাদের শরীর মাটির নীচে পোকায় খাবে সেই আমাদের এই স্পর্ধা শোভা যায় না। সে-জন্যই কোরাণ-রসুল কঠিনভাবে সে অধিকার আমাদের হাতে তুলে নিতে নিষেধ করেছেন। সুরা নিসা আয়াত ৯৪-তে কোরাণ সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছে, যে ইসলামী পদ্ধতিতে সালাম দেবে তাকে কেউ যেন অমুসলিম না বলে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কি সুন্দর কি কার্যকর নির্দেশ সেটা যা শারিয়াপন্থীরা বিভিনড়ব ব্যাখ্যার প্যাঁচ ক’ষে লঙ্ঘন করেন। কিন্তু সে-নির্দেশ আমাদের হজরত শাহ্ জালাল শাহ্ম খদুমের দল পদে পদে মেনে চলেছেন। বাংলার হাজার বছরে কোথাও একটা উদাহরণ নেই তাঁরা কাউকে কাফের বলে গালি দিয়েছেন। অথচ রাজনৈতিক মওলানারা ঐ আয়াতটার পটভূমির বাহানায় ওটাকে চিরন্তন না বলে তাৎক্ষণিক বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোরাণের ক’টা নির্দেশ শাশ্বত ? দাস-প্র া, বহুবিবাহ, নারীর অর্ধেক উত্তরাধিকার, অর্ধেক সাক্ষ্যের মতো বহু নির্দেশই তো তাৎক্ষণিক ! তাঁরা ওগুলো শাশ্বত করেছেন কারণ ওতে নারী-নিপীড়ন করা যায়, পুরুষতন্ত্রের স্বার্থরক্ষা হয়।

কে মুসলিম তা আমরা কোরাণ থেকে পেলাম। এ-ব্যাপারে রসুল কি বলেছেন ? কি করেছেন ? পড়ে দেখুন ‘কে মুরতাদ’ অধ্যায়ে। সেই সাথে খুলে দেখুন মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ মুহসিন খানের অনুদিত সহি বুখারি ৪র্থ খণ্ড, হাদিস ২৯৩ ও ২৯৪। সাহাবীদের প্রতি নবীজীর স্পষ্ট নির্দেশ-উদ্ধৃতি দিচ্ছি-“যাহারা নিজদিগকে মুসলমান বলিয়া ঘোষণা করিয়াছে তাহাদের তালিকা বানাও।” সাহাবীরা তা বানিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই দু’একজন হলেও মুনাফেক ছিল যারা ইসলাম-বিরোধীতা করার জন্যই প্রকাশ্যে মুসলমানিত্ব ঘোষণা করতো। এমন উদাহরণ ইতিহাসে আছে। নবীজী সেটা জানতেন না তা হতেই পারে না। কিন্তু তিনি কোনো প্রশড়ব না ক’রে তালিকার প্রত্যেকের মুসলমানিত্ব গ্রহণ করেছিলেন, কাউকেই বলেননি তার দাবী মিথ্যা, সে মুসলমান নয়। মানবচরিত্র তাঁর জানা ছিল, তিনি জানতেন তিনি যদি ঘোষণার পরেও কারো মুসলমানিত্ব অস্বীকার করেন তবে তার সুযোগ নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত নষ্ট মানুষেরা অন্য মুসলমানদের অমুসলিম বলবে, কাফের-মুরতাদ বলবে। তাঁর সেই দিব্যদৃষ্টি ব্যর্থ করেছি আমরা পরস্পরকে ‘কাফের’ বলেছি। ইমাম হানিফা, শাফি, মালিক, হানবল সহ আমাদের ইমাম, দার্শনিক বৈজ্ঞানিক, যাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করি, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকে ঐ ইসলাম-বিরোধী আঘাতের শিকার হয়েছেন। তাঁদের বলা হয়েছে তুমি মুসলমান নও, গালাগালি থেকে দেশান্তর, এমনকি হত্যাও করা হয়েছে। এভাবেই রসুলের আলোকিত উদাহরণ না মেনে আমরা নিজের পায়ে কুড়–ল মেরেছি, নিজেদের শক্তিক্ষয় করেছি। হতে পারে অনেকে ইসলামের অনেক কিছুই পালন করে না কিংবা যেভাবে পালন করে তা অন্যের সাথে মেলে না কিন্তু মূল ঈমানটা তো আছে। কাজেই কে মুসলিম কে নয় সেই গুরুভার বিচার করার মালিক আছেন মাথার ওপরে, ভ্রান্তিময় মানুষ সেই গুরু দায়িত্ব হাতে তুলে নেবার ক্ষমতা রাখে না ॥