shariakibole.com

পাকিস্তানের শারিয়া – বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

কোনকিছুকে স্পষ্ট করতে হাজার কথার চেয়ে একটা উদাহরণই যথেষ্ট। শারিয়ার উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের দিকে তাকানো যাক কারণ দু’দেশের শারিয়াপন্থী দলগুলোর ধ্যান-জ্ঞান, গঠন-চেহারা, চলন-বলন, আচার-ব্যবহার, ব্যক্তিত্ব-চরিত্র, কেতাব- উদ্দেশ্য ও বক্তৃতা-বিবৃতি হুবহু এক। বাংলাদেশে জামাতে ইসলামির প্রকাশিত প্রায় প্রতিটি শারিয়াপন্থী বই-ই আসলে উর্দু বইগুলোরই অনুবাদ। তাই বাংলাদেশে শারিয়া কায়েম হলে ফলাফলও পাকিস্তানের মতই হবার কথা। পাকিস্তানে বৈধ সরকার উচ্ছেদ করে জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতা দখল করে শারিয়াপন্থীদের সমর্থন লাভের জন্য শারিয়া প্রবর্তন করেন ১৯৭৯ সালে। শুরুর দিকে শারিয়া পেয়েছিল অভূতপূর্ব জনসমথর্ন , শারিয়ার তেমন কোন বিরুদ্ধপক্ষ ছিল না। তাই সম্পূর্ণ সুযোগ ছিল এ-কথা প্রমাণ করার যে, শারিয়া আইন দিয়ে দেশে উনড়বতি সম্ভব। সেটা তো হয়ই নি, বরং অন্ধবিশ্বাসীদের দাপটে পাকিস্তানের অবস্থা আজ বড়ই করুণ। তার কিছু চিত্র দেয়া হলো।

(ক) হুদুদ আইন নং ৭ (১৯৭৯), নং ২০ (১৯৮০) দ্বারা সংশোধিত, ৮-এর খ ঃ “পরকীয়া এবং ধর্ষণের (অর্থাৎ দু’টোতেই − লেখক) মামলায় শারিয়া- আদালতে সাক্ষী লাগবে চারজন বয়স্ক পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষ্য, নারী-সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।” পুলিশের কাছে ধর্ষণের অভিযোগ করতে গিয়ে ধর্ষিতারা চারজন বয়স্ক পুরুষ মুসলিম সাক্ষী আনতে পারে না। কাজেই তারা এ-আইনে অবৈধ দৈহিক সংসর্গের, অর্থাৎ জ্বেনার, অভিযোগে দোষী হয়ে পড়ে। এ কোন গল্প-কল্পনা নয়। এ হল ইসলামের নামে অসংখ্য মা-বোনের জীবন ধ্বংস করার মারাত্মক বাস্তব। এ-আইনে বন্দিনী ছিল সাড়ে তিন হাজার ধর্ষিতা নারী ও বালিকা। এতে সারা দুনিয়ায় ইসলামের অত্যন্ত বদনাম হয়েছে আর পাকিস্তানের নামে ঢিঢি দুর্নাম পড়ে গেছে।

(খ) ডঃ ফারজানা বারী, অ্যাক্টিং ডিরেক্টর, সেণ্টার ফর উইমেন স্টাডিজ, কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামাবাদ, বলেছেন ঃ “এই আইন পরকীয়া ও ধর্ষণকে একই চোখে দেখে এবং ইহাতে ওই দুই ক্ষেত্রেই চারজন মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষ্য প্রয়োজন…অর্থাৎ এই আইন ধর্ষককে রক্ষা করে। এই আইন হুদুদ মামলায় নারী ও অমুসলিমদের সাক্ষ্য অস্বীকার করে” (দ্য নিউজ, করাচি ১৪ই মে, ২০০২)। শুধু পাকিস্তানেই নয়, বহু দেশে এই একই আইনের যাঁতাকলে নারীর জীবন পিষ্ট হয়।

(গ) ডঃ আসমা জাহাঙ্গীর, পাকিস্তান মানবাধিকার সংস্থার প্রাক্তন পরিচালিকা বলেছেন ঃ “ ’অনার কিলিং’ প্রথায় খানদানের সম্মান বাঁচাতে পরিবারের মেয়েকে প্রেম বা পরকীয়ার সন্দেহে খুন করা হয়। পাকিস্তানে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি কন্যা-বোন তাদের বাবা-ভাইয়ের হাতে খুন হচ্ছে কারণ শারিয়ার কিসাস আইনে নিহতের পরিবার খুনিকে মাফ করলে খুনির মৃত্যুদণ্ড হয় না। যে পরিবারে এমনিতেই একজন মেয়ে খুন হয়েছে, সে আবার আরেকজনকে হারাতে চায় না, সে খুনি হোক না মেয়ের বাবা বা ভাই। তাই তারা খুনিকে ‘মাফ’ করে। এদিকে দেশ জুড়ে বাবা-ভাইরা জেনে গেছে যে কন্যা-বোনকে খুন করলে অন্তত মৃত্যুদণ্ডটা হবে না। তাই শারিয়া আসার পর এই খুন বেড়ে গিয়ে সর্বগ্রাসী মহামারীর আকার ধারণ করেছে” (সাক্ষাৎকার টরণ্টো টেলিভিশন, ২০০৬)।

(ঘ) ২০০৩ সালে মুত্তাহিদা মজলিস-এ আমল নামে শারিয়াপন্থী দল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, এখন সে-দল বেলুচিস্তানের কোয়ালিশন সরকারেও আছে। সংসদে বসে এরা প্রমেই বন্ধ করে জুয়া, মদ, বাস-ট্রেনে সঙ্গীত, বিজ্ঞাপন-পোস্টারে নারীর ছবি, বিচিত্রানুষ্ঠানে- রেডিও-টিভিতে মেয়েদের গান ও নাটক। সঙ্গীত-শিল্পীদের মারপিট করা শুরু হয় এবং সিনেমা হলগুলোতে সিনেমা বন্ধ করা হয়। আর তার পরেই সংসদ ঘোষণা করে, “ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার জন্য” আল্ট্রাসাউণ্ড ও ইসি- জি পরীক্ষায় রোগিণীরা পুরুষ টেকনিশিয়ানের কাছে যেতে পারবে না। খবরে প্রকাশ, সারা প্রদেশে ই-সি-জি’র নারী-টেকনিশিয়ান আছে মাত্র একজন, আল্ট্রাসাউণ্ডের একজনও নেই ! যেখানে নারী-শিক্ষার হার মাত্র ৫% সেখানে এর চেয়ে বেশি টেকনিশিয়ান গড়ে ওঠা সম্ভবও নয়। সেখানে মা-বোনদের কি অবস্থা তা অনুমান করে নিন।

(ঙ) পাকিস্তানে ২০০০ সালে সরকারকে এ-সব ব্যাপারে পরামর্শ দেবার জন্য গঠিত সুপ্রীম কোর্টের জাস্টিস মজিদা রিজভী’র নারী-অধিকার কমিটি (ঘঈঝড) রিপোর্ট ঃ “বিশজন সদস্যের মধ্যে আঠারো জনই হুদুদ আইন বাতিল করতে বলেছেন। হুদুদ আইনের মধ্যে এত বেশি সমস্যা আছে যে এটাকে সংশোধন করা সম্ভব নয় …।” ধর্ষকের শাস্তি হয় না বলে স্বভাবতই পাকিস্তানে ধর্ষণ বেড়ে গেছে, এমনকি ধর্ষিতা থানায় অভিযোগ করতে এসে পুলিশ দ্বারা আবারও ধর্ষিতা বা গণধর্ষিতা হবার ঘটনাও বেড়ে গেছে অবিশ্বাস্যভাবে। বিচারক মজিদা রিজভী এ-ও বলেছেন এ-আইন যতদিন থাকবে ততদিন হুমকি ও ব্যাকমেল হতে থাকবে। অনেক আগে ১৯৯৪ সালে নাসির আসলাম জাহিদ-এর নেতৃত্বে যে ‘নারী বিষয়ক কমিশন’ গঠিত হয়েছিল, সেটাও রায় দিয়েছিল হুদুদ আইন বাতিল করার জন্য। করাচির আইনজীবী পারভীন পারভেজও বলেছেন, এ-সব আইন প্রধানত প্রতিশোধ নেয়ার ষড়যন্ত্রেই খাটানো হয়। এতসবের পরেও পাকিস্তানে এ-সব হুদুদ আইনের কোনরকম পরিবর্তন করা যায়নি। আমাদের বুঝতে হবে, কোন অন্যায় আইনও যদি একবার শারিয়া আইন হিসেবে বৈধ হয় তবে শারিয়াপন্থীদের চাপে তাকে উচ্ছেদ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ ওরা এ চেষ্টাকে ‘ইসলাম-বিরোধী ষড়যন্ত্র’ বলে প্রচার করে।

(চ) পাকিস্তানের আরেক মারাত্মক আইন হল ব্যাসফেমি আইন। আইনটা হল কেউ চারজন বয়স্ক পুরুষ মুসলমানের সামনে ইসলাম, কোরাণ, নবীজী বা সাহাবিদেরকে অপমান করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আইনটা শুনতে খুবই ভাল, কিন্তু মুশকিলটা হল ‘অপমান’ বলতে আসলে কি বুঝায় এবং কে কার কোন্ক থায় ‘অপমান’ বোধ করবেন তা ঠিক করা অসম্ভব। তাছাড়া, যারা থানায় বা আদালতে বলবে তারা অমুককে ইসলামের ‘অপমান’ করতে শুনেছে-দেখেছে সেই চারজন ‘সাক্ষী’ জোটানো কঠিন নয়। কিছু বন্ধু থাকলেই হল, কিংবা হুমকি বা টাকা দিয়েও এ-সাক্ষী জোটানো যায়। আর, এ-আইন অনুযায়ী সাক্ষী থাকলেই পুলিশ ‘অপরাধী’-কে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য, আদালত তাকে শাস্তি দিতে বাধ্য। গত বছর ইংল্যাণ্ডের পার্লামেণ্টে যখন প্রস্তাব হয়েছিল ব্ল্যাসফেমি আইন বানানো হোক তখন শারিয়াপন্থীরা দৌড়ে গিয়েছিলেন প্রধান মন্ত্রী টনি ব্ল্যায়ারের কাছে এই অনুরোধ নিয়ে, এ-আইন থেকে হাদিসকে রেহাই দেয়া হোক। কারণ তাঁরা ভালো করে জানেন সহি হাদিসগুলোতে সাহাবিদের চুরি, ডাকাতি, পরকীয়া, খুনোখুনি, অন্য ধর্মের প্রতি অপমান-ঘৃণা-হিংস্রতা ইত্যাদির শত শত ঘটনা আছে। যাহোক, পাকিস্তানে কেউ ওগুলোর উদ্ধৃতি সহি হাদিস থেকে দিলেও ব্যা সফেমি আইনের পালায় পড়ে যাবে। এ-ভাবে ইসলামের গঠনমূলক সমালোচনাকে ‘ইসলামের অপমান’ হুমকি দিয়ে শারিয়ার অন্যায় আইনগুলোকে রক্ষা করা হয়েছে। অতীত-বর্তমানে বহু ইসলামি চিন্তা বিদ এ-আইনেই ‘মুরতাদ’ ঘোষিত হয়ে খুন হয়েছেন বা হেনস্থা-দেশছাড়া হয়েছেন, তাঁদের বিশাল লাইব্রেরী পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইসলামের ইমামরা তো এর ভুক্তভোগী হয়েছেনই, আমরা যাঁদের নিয়ে গর্ব করি সেই ইবনে রুশদ্, ইবনে খালদুন, ইবনে সিনা প্রমুখ বৈজ্ঞানিক-দার্শনিকের ওপরে শারিয়ারাষ্ট্র এই আইনেই অতীতে কি অসহ অত্যাচার করেছে তা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। মুসলিম-বিশ্বের অনেক অধঃপতনের জন্য দায়ী এই মহা শক্তিশালী আইন। পাকিস্তানে অসংখ্য বদমাশেরা এ-আইনকে খাটায় প্রেম- জমিজমা-ব্যবসার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বা প্রতিশোধ নিতে, আর ধর্মীয় লেবাস পরা অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অজ্ঞ মোলারা খাটায় বিশেষজ্ঞদের টুঁটি চেপে ধরতে। এ-রকম অনেক ভুক্তভোগীর দলিল আমাদের কাছে আছে।

২০০৫ সালে পাকিস্তানের জিও টিভি’র সাক্ষাৎকারে কেন্দ্রীয় শারিয়া কোর্টের উপদেষ্টা, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় ধর্মমন্ত্রী, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রধান খতিব, প্রাক্তন আইন-সেক্রেটারী, তাহরিক-এ আমারাত শারিয়াত-এর আমীর, ডেপুটি ডিরেক্টর ইকবাল অ্যাকাডেমি, প্রাক্তন ডিরেক্টর-জেনারেল দাওয়াহ অ্যাকাডেমি, শারিয়া বিভাগের ডীন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, এবং আরও অনেক বিখ্যাত ইসলামি নেতৃবৃন্দ বলেছেন, জ্বেনা ও ধর্ষণের আইনটা ইসলাম-বিরোধী। কিন্তু শারিয়াপন্থী রাজনৈতিক দল এ-আইন উচ্ছেদ তো দূরের কথা, ছুঁতেও দেবে না।

১৫ই নভেম্বর ২০০৬ (৩৬ মুক্তিসন) যখন এ নিবন্ধ আমি লিখেছি তখন বি-বিসি’ে ত খবর দেখেছিলাম পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে ‘নারী-রক্ষা বিল’ প্রস্তাব পাশ হয়ে গেছে, এখন এটা প্রেসিডেণ্টের কাছে গেছে, তাঁর শুধু সই করাই বাকি। এতে শারিয়াপন্থী রাজনৈতিক দল ক্ষিপ্ত হয়ে দেশব্যাপী আন্দোলনের ও সংসদ থেকে পদত্যাগের হুমকি দিয়ে বলেছে “শারিয়া মোতাবেক এই আইনই সঠিক, এর কোন রকম পরিবর্তন কোরাণ ও শারিয়ার খেলাফ। এ-পরিবর্তন দেশকে অবাধ যৌনতার স্বর্গ বানাবে।” ওদের ওই কথা ঠিক কি না আপনারাই বলুন আরেকবার আইনটার দিকে তাকিয়ে। “পরকীয়া ও ধর্ষণের প্রমাণ হবে চারজন বয়স্ক পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষ্য বা অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি” − নারী সাক্ষ্য চলবে না, হুদুদ আইন নং ৭ (১৯৭৯), নং ২০, ৮-এর খ (১৯৮০) দ্বারা সংশোধিত। এই হল পাকিস্তানের শারিয়াপন্থীদের মানসিকতা।

সব মিলিয়ে পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা বড়ই করুণ। একই দুর্ভাগ্য হয়েছে নাসেরের মিশরের, ডঃ মোসাদ্দেকের ইরাণের, এবং সুকর্নোর ইন্দোনেশিয়ার। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এইসব গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর প্রতিটি নেতাই ছিলেন শারিয়া-রাষ্ট্রের বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রবক্তা। অথচ আজ এসব দেশ শারিয়া-ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্রের মরীচিকার পেছনে এতিমের মত ঘুরছে। মুহম্মদ আলী জিনড়বাহ স্বপড়ব দেখেছিলেন এবং সংসদে প্রম বক্তৃতায় সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক গণতন্ত্রের, সেই পাকিস্তান এখন ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্রের সুকঠিন বেড়াজালে বন্দি। অথচ ১৯৪১ সালে কংগ্রেস নেতা কে.এম.মুন্সী যখন বলেছিলেন পাকিস্তান হবে শারিয়া-ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র তখন অনতিবিলম্বে জিনড়বাহ গর্জে উঠে বলেছিলেন ওটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা, পাকিস্তান হবে ইংল্যাণ্ড ক্যানাডার মত আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র − (পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি, প্রক্তিন রাষ্ট্রদূত কামরুদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা ৫২)। ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগ নেতা মাহমুদাবাদের নবাব যখন বলেছিলেন পাকিস্তান হবে ইসলামি রাষ্ট্র, জিনড়বাহ অনতিবিলম্বে ওই একই ঘোষণা দিয়েছিলেন − পিতৃভূমি ও স্বরূপ অন্বেষণ − কামরুল হাসান। সেই জিনড়বাহ এখন পাকিস্তানে ফিরে এলে কি নিজের দেশ চিনতে পারবেন ? তিনি কি বিশ্বাস করতে পারবেন তাঁর দেশের শক্তিশালী শারিয়াবাজ ফয়জুলাহ উন্মুক্ত ঘোষণা দিচ্ছে পোলিয়ো’র টিকা নেয়া চলবে না, ও টিকা শারিয়ায় হারাম এবং ঐ রোগে মারা গেলে মানুষ শহীদ হবে ! − (http://ace.mu.nu/archives/216745.php)।

নাইজিরিয়ার শারিয়াবাজেরা তো জাতিসঙ্ঘের পোলিয়ো’র টিকা-দলকে দেশে ঢুকতেই দেয়নি − ও টিকা নাকি মেয়েদের বন্ধ্যা করার পশ্চিমা ষড়যন্ত্র। জিনড়বাহ কি চিন্তাও করতে পারবেন তাঁরই সৃষ্ট দেশের সরকার কিভাবে শারিয়াপন্থীদের সামনে এত অসহায় হয়ে পড়ল ! উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে শারিয়া-সরকার গঠনের পর সেখানে কি হয়েছে তা আগে বলা হয়েছে। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান আবদুল ওয়াহিদ জাকোতি বলেন সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে − (পাকিস্তান নিউজ ৮ই মে, ২০০৭)। জিনড়বা’র কেমন লাগবে যখন তিনি দেখবেন ওরা নিজেদের গৌরবময় সভ্যতার ঐতিহ্যকেও অস্বীকার করছে ? ২০০৭ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারীতে সংসদে তারা মারমুখী হয়ে দাবি করেছে স্কুলের বই থেকে সিন্ধু অববাহিকার বিশ্ববিখ্যাত গান্ধারা সভ্যতা, মহেঞ্জোদাড়ো-হরপ্পা এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ পর্ব, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যরে ইতিহাস ইত্যাদি সবকিছু বাদ দিতে হবে, বাচ্চাদের ওগুলো জানা চলবে না। শিক্ষামন্ত্রী এর প্রতিবাদ করলে তারা চিৎকার করতে করতে সংসদ থেকে বেরিয়ে গেছে − “ওগুলো আপনাদের ইতিহাস হতে পারে কিন্তু আমাদের ইতিহাস শুরু হয়েছে মক্কা-মদীনা থেকে”− (দ্য ডন, ২২শে ফেব্রুয়ারী ২০০৭) − http://www.dawn.com/2007/02/22/top2.htm জিনড়বাহ হয়ত আত্মহত্যা করবেন যখন দেখবেন সংসদের স্পীকার শারিয়াপন্থীদের এ-প্রস্তাব বাতিল করার সাহস পাননি − কি এক অখ্যাত কমিটির কাছে পাঠিয়েছেন “সিদ্ধান্তের” জন্য।

সরকারের এই নতজানু নীতির ফলে ওদের সাহস ও দাবি অবধারিত বাড়তে থাকে। বাংলাদেশেও ঘটেছে এটা। যে বাংলাদেশে একটা বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় নেই সেখানে তারা আরবি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য হুঙ্কার দেয়। নিজেরই শিল্প-সংস্কৃতি ওদের কাছে র্শিক হয়ে দাঁড়ায়। ওদের কাছে আমাদের শহীদ মিনারে ফুল দেয়া র্শিক, মুক্তিযুদ্ধের শিখা চিরন্তনী র্শিক, নববর্ষের উৎসব র্শিক, মায়াময় বাঙালিনীর নাচ-গান-টিপ-শাড়ির মায়াময় সংস্কৃতি সবই আপত্তিকর। পাকিস্তানেও বাসন্তী উৎসব বাতিলের দাবি উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বাদশারা শারিয়াপন্থীদের এভাবেই গড়ে তোলে যাতে মুসলিম-বিশ্ব তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে আরবের সাংস্কৃতিক উপনিবেশ হয়ে আরব-সংস্কৃতি পালনের মধ্যে সওয়াব খুঁজে ওদের পদলেহী হয়ে থাকে।

পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা সত্যি করুণ। নীচের সংবাদগুলো নেয়া হয়েছে প্রধানত পাকিস্তানের পত্রিকা ডন, ইণ্টারন্যাশনাল নিউজ, ডেলী টাইম্স্ ইত্যাদি থেকে। ফেব্র“য়ারী ২০০৭ থেকে ইসলামাবাদের লাল মসজিদের খতিব ইমাম মওলানা আবদুল আজিজ শারিয়া-আন্দোলনে নেমেছে এবং হাজার হাজার অন্ধবিশ্বাসীকে ‘শারিয়া বা শহীদ’ ¯োগাে ন উত্তেজিত করতে পেরেছে। তারা মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে অস্ত্র হাতে তুলে নেবার নির্দেশ দিয়েছে ও প্রেসিডেণ্ট হাউসে আত্মঘাতী বোমা মারার হুমকি দিয়েছে। হাজার হাজার ছাত্ররাও আত্মঘাতী হতে তৈরি হয়ে আছে। সরকার পুরোপুরি শারিয়া প্রয়োগ করেনি এই অজুহাতে তারা দশজন ইমামকে সাথে নিয়ে বলেছে সরকারের কোন দরকার নেই, তারা নিজেরাই শারিয়া প্রয়োগ করতে পারে। তারা মসজিদ-ভিত্তিক শারিয়া কোর্ট বানিয়ে ফেলেছে এবং তাদের শারিয়া-বাহিনী পুরো ইসলামাবাদকে এক হিসেবে দখল করে রাস্তায় রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। আপনাদের মনে আছে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে ২৩শে ফেব্র“য়ারী ২০০৬ সালে আমাদের শারিয়াপন্থীরা ঘোষণা দিয়েছিলেন তাঁদের গ্রাম থেকে জেলা হয়ে বায়তুল মোকাররম পর্যন্ত এক মহা শারিয়া-আদালত গড়ে তুলবেন ? একই দেশে এটা এক সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা যা পরিষ্কার রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তাই তাঁরা এটাকে বলবেন ‘ইসলামি পরামর্শ ব্যবস্থা’ − যাতে আইনের পালায় না পড়তে হয়। খেল্টা সরকার বা জনগণ বুঝতে পারলেও কিছুই করতে পারবে না। তারপরে তাদের বেসরকারি ‘শারিয়াপুলিশ’ এসে এমন ভয়ঙ্কর সামাজিক চাপ ও ধর্মীয় আবেগ সৃষ্টি করবে যে কেউ সরকারি আদালতে যেতে পারবে না। এ এক ভয়াবহ পরিকল্পনা যা ইউরোপে অত্যন্ত সফল এবং যা ঠেকাবার কোনই আইনগত উপায় নেই। পাকিস্তান সরকারের নাকের ডগায় এ বাহিনী অনেক গানের সিডি-ডিভিডি-ভিডিওর দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে ও বাকি দোকানগুলোকে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। লষ্কর-এ তৈয়েবা জাতীয় অসংখ্য জঙ্গী দল এতে সমর্থন দিয়েছে। সারা দেশে এ-নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে − করাচির সুশীল সমাজ প্রচণ্ড প্রতিবাদ করেছে। কিন্তুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ করেছে, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেণ্ট। বাকি সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত। এর আগে পাকিস্তানের খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ পাদ্রী তাঁর পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিয়েছেন এই দুঃখে, নিজের দেশেই তাঁদের কোনই সম্মান ও অধিকার নেই। কেন্দ্রীয় ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সংসদ দু’টো উত্তেজনা ও বাক্যুদ্ধে সদা থরহরি কম্পমান।

তারপরে মন্ত্রী সাহেব লাল মসজিদে গিয়ে শারিয়া-মওলানার সাথে সংলাপ শেষে সাংবাদিকদেরকে সুখবর দিলেন − “শারিয়াপন্থীদের সব দাবি মেনে নেয়া হয়েছে…কারণ দেশে শারিয়া-বিরোধী কেউ নেই।”

ব্যাস, কেচ্ছা খতম।

গত ১২ই মে, ২০০৭ তারিখে পাকিস্তান কেঁপে উঠেছে তার ইতিহাসে ভয়াবহতম রাজনৈতিক দাঙ্গায়। করাচীতে খুন হয়েছে অন্ততঃ ৪০ জন, দু’জন পুলিশ সহ। সঙ্ঘর্ষ আরও ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক প্রাণহানী হবে এটা সবাই বলছেন। দাঙ্গাটা বরখাস্ত প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীকে কেন্দ্র করে হলেও অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে আছে শারিয়া। তার পক্ষে-বিপক্ষে দু’দলই অস্ত্রে সজ্জিত, দু’দলের গর্জন-হুঙ্কারে পাকিস্তানের আকাশ-বাতাস কম্পমান এবং সরকার হয়ে পড়েছে কোণঠাসা। এদিকে ইফতেখার চৌধুরীর পরে সাংবিধানিকভাবে অ্যাক্টিং প্রধান বিচারপতি হয়েছেন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারপতি ভগবান দাস। তাতে শারিয়াপন্থীদের প্রচণ্ড গাত্রদাহ শুরু হয়েছে, তাঁরা ঘোষণা দিয়েছেন সাংবিধানিক হোক বা না হোক কোন অমুসলিম পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি হতে পারবে না। আইনগত অধিকার থাকলেও বেচারা ভগবান দাস এখনও অ্যাক্টিং থেকে পূর্ণ প্রধান বিচারপতি হতে পারেননি, পারবেন বলে মনেও হয় না। অথচ পাকিস্তানের শুরুর দিকে প্রধান বিচারপতি মোঃ মুনিরের অবসর গ্রহণের পর ১৯৬০ সালের মে থেকে ফেব্র“য়ারী ১৯৬৮ পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর প্রধান বিচারপতি ছিলেন ক্যাথলিক খ্রীষ্টান বিচারপতি অ্যালভিন রবার্ট কর্নেলিয়াস। আইনের জয় হয়েছে ও কারো কোন প্রতিবাদ ওঠেনি কারণ তখনো পাকিস্তান শারিয়া-মানসিকতায় আক্রান্ত হয়নি।

এখানে একটা কথা না বললেই নয়। লর্ড কর্ণওয়ালিস ভারতের অন্য কোন জায়গায় না করে শুধুমাত্র বাংলায় আইন করেছিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের, যাতে জমিদাররা বৃটিশ সরকারকে টাকা দিয়ে জমিদারি কিনত এবং অত্যাচার করে খাজনা আদায় করে বড়লোক হয়ে যেত। এতে করে সব পুঁজি লগীড়ব হল উৎপাদনহীন জমিদারি ব্যবসায়ে, অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাংলায় শিল্প-কারখানার কবর হয়ে গেল। আগে থেকেই ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির দাবি ছিল বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদের, সে দাবি পরে মুসলিম লীগ নিজের করে নিয়ে ষাট দশকের প্র ম দিকে জমিদারি উচ্ছেদের আইন পাশ করে, যদিও ক্ষতিপূরণ সহ। আমরা জমিদারি মুক্ত হই কিন্তু আইনের ফাঁকে পাকিস্তানে ওরা ওদের জমিদারি ঠিকই বাঁচিয়ে রেখেছিল, আজও যা বহাল তবিয়তে আছে। পাকিস্তানের রাজনীতি তাই ভূস্বামী-জমিদারেরাই নিয়ন্ত্রণ করছে। কাজেই জমিদার-মুক্ত বাংলা এবং জমিদার-ভুক্ত পাকিস্তানের রাজনীতির ধারাটাই সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়। আমাদের রাজনীতিতে দুর্নীতি ভয়াবহ কিন্তু সেটা মেরামতের যোগ্য। পাকিস্তানের মত আমাদের রাজনীতি সামন্তশ্রেণীর কুক্ষিগত নয়। আমাদের জাগ্রত নারী-সমাজ আছে − বুদ্ধিমান সুশীল সমাজ আছে, অগ্রসর জাতি আছে।

ওগুলো আছে আমরা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ বানিয়েছি বলেই। নাহলে কেন্দ্রের সামরিক প্রেসিডেণ্টের কলমের খোঁচায় আমরাও শারিয়া-দেশ হয়ে ওই অনৈসলামিক মোলাদের খপ্পরে পড়ে যেতাম। প্রতিবাদ প্রতিরোধ পার হয়ে বাঙালি একদিন নিশ্চয়ই পৌঁছে যেত দুর্বার প্রতিশোধে, কিন্তু তাতে অজস্র রক্তক্ষয় হত, যেমন হয়েছে একাত্তরে। কিন্তু শারিয়া আইনগুলোর যেহেতু দেশ চালাবার সামর্থ্য ও শক্তি নেই তাই অনেক ভোগান্তি ভুগে অনেক রক্তক্ষয় করে পাকিস্তানকে ফিরে আসতেই হবে ধর্মনিরপেক্ষ সরকারে। ইরাণের ভাগ্যেও এই একই রক্তাক্ত নিয়তি অপেক্ষা করছে। শারিয়া আইনগুলো না বদলালে এ দুই দেশে শারিয়ার পতন হবেই একদিন, − তাতে বিশ্ব-মুসলিমের বড় রকমের একটা বিবর্তন হবে। কিন্তু এ-মুহূর্তে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে পাকিস্তানের ভোগান্তি থেকে। দেখে না শিখলে আমাদেরকে ঠেকে শিখতে হবে ভয়াবহ মূল্য দিয়ে ।

পাকিস্তানের মতই আমাদের বাংলাদেশেও নারী-অধিকারের চেষ্টা প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে আমাদের শারিয়াপন্থী দল দ্বারা। সংসদে এ-বিল প্রস্তাবের পর কি মারাত্মক ষড়যন্ত্রময় খবর উঠেছে দেখুন, সারাংশ ঃ

“সরকার দ্বারা গৃহীত ‘জাতীয় নারী উনড়বয়ন নীতি −৯৭’-এর বেশ কয়েকটি ধারা বদলে ফেলা হয়েছে। গৃহীত নীতির ৭.১ ধারায় বর্ণিত ‘সমান অধিকার’ শব্দ দু’টিকে বাদ দিয়ে করা হয়েছে ‘সংবিধান-সম্মত অধিকার।’ ৭.২ ধারার বিভিনড়ব স্থানে বর্ণিত ‘সম্পদ, বাসস্থান, অংশীদারিত্ব, উত্তরাধিকার, সম্পদ, ভূমির ওপর নারীর অধিকার’ লাইন ও শব্দগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। ৭.৩ ধারায় ‘নারীর সর্বাত্মক কর্মসংস্থান’- কে বাদ দিয়ে করা হয়েছে ‘যথোপযুক্ত।’ ধারা ৮ থেকে রাজনীতিতে, মন্ত্রীপরিষদে, সংসদে ও বিদেশে দূতাবাসে নারীর ক্ষমতায়নের কিছু জায়গায় অংশ ও কিছু জায়গায় পুরোটাই বাদ দেয়া হয়েছে” (খবর বি.বি.সি’র)। আমাদের শারিয়াপন্থীরাও এখনও নারীর রাজনীতি করার ঘোর বিরোধী – দৈনিক ইনকিলাব, ২৬ মে ২০০৭। তাঁরা বুঝতে পারছেন না আমাদের নারীরা মূর্খ নন, তাঁদের ধূর্তামি বুঝবার মতো যথেষ্ট জ্ঞানবুদ্ধি আমাদের নারীদের আছে। সময়মতো তাঁরা ঠিকই শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে হাতে ঝাঁটা তুলে নেবেন।

আমি বুঝতে পারি না নারীরা এমন কি অপরাধ করেছেন, দেশে দেশে নারীর বিরুদ্ধে এমন ষড়যন্ত্র, এমন যুদ্ধঘোষণা কেন করা হয়েছে, তা-ও আবার ইসলামের নামে ! বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের ফতোয়ার আদালতেও শারিয়া আইনে ধর্ষিতা নারী বা বালিকাকে চাবুক মেরে শাস্তি দেবার বহু দলিল আমাদের কাছে আছে। পড়ে যাঁদের মনে কষ্ট লাগে তাঁরা নিজেকে এই বুঝ দেন যে, ওগুলো অজ্ঞ মোলার অপপ্রয়োগ। কিন্তু যত অবিশ্বাস্যই হোক আসলে ওগুলোই শারিয়া আইন। উদাহরণ দিচ্ছি − বাকি শত শত উদাহরণ পাবেন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রের প্রকাশিত ‘ফতোয়া ১৯৯১-১৯৯৫’ বইতে।

১। মানিকগঞ্জ জেলার গাড়পাড়া ইউনিয়নের তেঘুরি গ্রামে এত ১৩ বছর বয়সের বালিকা তার সৎ-পিতার দ্বারা ধর্ষিতা হইলে ফতোয়ার আদালতে স্থানীয় বর্ষীয়ান ব্যক্তিগণ ধর্ষক এবং ধর্ষিতা দুইজনকেই জুতা দ্বারা প্রহার করিতে করিতে গ্রাম হইতে বাহির করিয়া দেয় − দৈনিক প্র ম আলো ৩০শে আগস্ট, ২০০২।

২। চান্দাইকোনা ইউনিয়নের ঐখোলা গ্রামের দুই কিশোরী কন্যা (১০ ও ১২ বছর) এক তাঁত ব্যবসায়ীর বাড়িতে ধর্ষিতা হলে মাতব্বর আবদুর রহমান খান, আছাব ও মওলানা আবু বকর ফতোয়া দিয়ে তাদেরকে ১০১ ঘা র্দোরা মারার নির্দেশ দেন। প্রায় ৫০ র্দোরা মারার পর ঐ কিশোরী অজ্ঞান হয়ে যায়। পরে তাকে সুস্থ করে বাকি ৫১ র্দোরা কার্যকর করা হয়। ঐ কিশোরী আবার জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকে মাটিতে। বড় বোনের শাস্তি দেবার পর ছোট বোনের শাস্তি নির্ধারণের জন্য আবার বৈঠক শুরু হয় − সাপ্তাহিক দেশে-বিদেশে ১৫ই মার্চ ২০০২।

৩। ভৈরবে স্থানীয় মাতব্বররা এক ধর্ষিতা কিশোরীর ইজ্জতের মূল্য ৫ হাজার টাকা ধার্য করলে ধর্ষক ৫ হাজার টাকা দিয়ে তার অপকর্মের শাস্তি থেকে রেহাই পায় (ভোরের কাগজ ১৫ই জুলাই, ২০০৫)। এ-শাস্তি শাফি’ আইনে বৈধ − উদ্ধৃতি দিচ্ছি ঃ “যদি কোন ব্যক্তি শক্তি প্রয়োগ করিয়া কোন নারীকে যৌনকর্মে বাধ্য করে তবে সে ঐ-নারীর উপযুক্ত দেন-মোহরের পরিমাণ অর্থ দিতে বাধ্য থাকিবে”− আইন নং m.8.10 । দেখতেই পাচ্ছেন এখানে অন্য শাস্তির কথা নেই, তাই শারিয়া কোর্টে টাকা জরিমানা দিয়ে ধর্ষকের মুক্ত হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাছাড়া ধর্ষক গরিব হলে, জরিমানা দিতে না পারলে কি হবে সেটা উলেখ থাকা দরকার ছিল।

৪। সিরাজগঞ্জে থানায় আমজাদ এক বিধবাকে ধর্ষণকালে হাতেনাতে ধরা পড়ে। ফতোয়ার শারিয়া-আদালতের রায়ে ধর্ষিতা ও ধর্ষক উভয়কে ১০১ ঘা র্দোরা ও ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা ধার্য করা হয় (ভোরের কাগজ ১৪ই এপ্রিল, ২০০৫)।

৫। সালাঙ্গা থানার চক গোবিন্দপুর গ্রামে হাফিজুর চার-পাঁচজন সঙ্গী সহ বিশ বছর বয়স্কা স্বামী-পরিত্যক্তা জয়গুনকে জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে ১২-দিন ধরে ক্রমাগত ধর্ষণ করে। সালিশি সভায় মওলানা আবদুল মানড়বান এবং গ্রামের বয়স্ক ব্যক্তিবর্গ ফতোয়া দ্বারা ধর্ষিতা জয়গুন বিবিকে আশিটি বেত্রাঘাত, এবং ধর্ষণকারী হাফিজুর রহমানকে আশিটি বেত্রাঘাত ও দশ হাজার টাকা জরিমানা করে (ভোরের কাগজ ১লা জুলাই, ২০০২)।

৬। তোফাজ্জল মাতব্বর তিন সন্তানের মা’কে ধর্ষণ করে। ধর্ষক ধরা পড়ে ও অপরাধ স্বীকার করে। চরমোনাই পীরের মুরীদ আলী খাঁ’র সভাপতিত্বে ধর্ষিতা ও ধর্ষককে ৪০ জুতোপেটা, আর ধর্ষকের আরো পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় (ভোরের কাগজ ১০ই জুলাই, ২০০৩)।

যে কোন বিবেকবান মানুষের বুক এ-সব ঘটনায় কেঁপে ওঠার কথা। বাংলাদেশ যদি কোন একটা দিকে অকার্যকর রাষ্ট্র হয়ে থাকে তবে এটাই সেটা।

মুসলিম-বিশ্বের চোখের সামনে প্রতিদিন এ-রকম হাজারো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারি না আমাদের ইসলামি দলগুলো কেন ইসলামের ওপরে এই কলঙ্ক ও মা-বোনের ওপর এ নিষ্ঠুরতার কার্যকর প্রতিবাদ করেন না। মুশকিল হচ্ছে, কোন দেশে শারিয়া আইনে মানুষের কষ্ট হলে অন্য দেশের শারিয়াপন্থীরা বলেন ওটা শারিয়ার অপপ্রয়োগ, ওরা শারিয়া বোঝেন না, আমরা ক্ষমতা পেলে সব ঠিক করে ফেলব। যেমন একদিকে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাশালী প্যালেস-ইমামের দল, অন্যদিকে ইণ্টারনেটের সুবিশাল শারিয়া-সংগঠন ইসলাম-অন্-লাইন। এখানে হাজারো প্রশেড়বর জবাবে যে ফতোয়া দেয়া হয় তা পালন করেন অসংখ্য মুসলিম। এর কন্সালট্যাণ্ট প্রফেসর শাহুল হামিদকে মধ্যপ্রাচ্যে শারিয়া আইনে মানুষের ওপরে অত্যাচারের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাব দেন ঃ “(মধ্যপ্রাচ্যের) যেসব শাসক ইসলামি আইন প্রয়োগ করেন তাঁহারা শারিয়ার মর্মবাণী হয় জানেন না বা তার প্রতি অসৎ … জনগণকে ভয় দেখাইয়া বা ঠকাইয়া তাঁহারা তাঁহাদের গদি রক্ষা করেন … কোরণ-রসুলের দেয়া ন্যায়বিচারের মানদণ্ড মানিয়া চলিতে ব্যর্থ হয়” − http://www.islamonline.net/livedialogue/english/Browse.asp hGuestID=wF8p2Z এই হল অবস্থা।

নীচে দেখুন, বিশাল শারিয়া-প্রতিষ্ঠানের মুফতি কিভাবে অসংখ্য নারীর জীবন ধ্বংস করে চলেছেন ইসলামের নামে।

ফতোয়া নং ১৩৩৮৩ দক্ষিণ আফ্রিকা। ২৬ আগস্ট, ২০০৫, শুক্রবার। বিভাগ − আইন ও রায়, মওলানা আমরান ভাওদা, ফতোয়া বিভাগ

প্রশড়ব ঃ যদি কোনো শ্বশুর তার পুত্রবধূকে স্ত্রী মনে করিয়া যৌন-লালসায় স্পর্শ করে তবে এ-ব্যাপারে শারিয়ার রায় কি ?

উত্তর ঃ এ-রকম হইলে সেই পুত্রবধূর বিবাহ চূড়ান্তভাবে বাতিল হইয়া যাইবে।

মুফতি ইব্রাহীম দেশাই কর্তৃক পরীক্ষিত ও অনুমোদিত শারিয়া রায় (সারাংশ) ঃ “কেহ যদি তাহার পুত্রবধূকে লালসার সহিত স্পর্শ করে তবে তাহার পুত্র ও পুত্রবধূ পরস্পরের প্রতি হারাম হইয়া যাইবে। তাহারা আর স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাস করিতে পারিবে না। এতদ্বারা মুসলমানদিগকে জানানো যাইতেছে যে, দারুল ইফ্তা’র কাছে লোকে প্রায়ই এই পরিস্থিতি লইয়া আসে। ইহার ফলে চিরতরে বিবাহবি”ে ছদ হইয়া যায় ও হৃদয়বিদারক অবস্থার সৃষ্টি হয়।”

বলাই বাহুল্য, মুফতি নিজেই এই নৃশংস ‘হৃদয়বিদারক অবস্থা’র সৃষ্টি করে তারপর কুম্ভীরাশ্র“ বর্ষণ করেছেন। আমরা জানি, কোন হারাম দ্বারা কোন হালালকে বাতিল করা যায় না (বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ৩য় খণ্ড পৃঃ ৫৩৭)। তাই কারো পাপ দ্বারা অন্য কারো বিয়ে বাতিল হতে পারে না। বিয়ে বাতিল হলে বেচারা স্ত্রীর ওপরে কি বজ্র নেমে আসে তা এই মুফতিদের উপলব্ধির বাইরে। নিরপরাধ এই মুসলিম নারী ঘর হারিয়ে নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে, সন্তান হারায়, স্বামী হারায় এবং তার সামনে থাকে অন্ধকার, উপবাস অথবা গণিকাবৃত্তি। এই সব মুফতিদের জন্যই নজরুল বলে গেছেন ঃ “ও হাত হইতে কোরাণ-হাদিস নাও জোর করে কেড়ে।” আমরা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেস-এর অফিসিয়াল প্যাড-এ এই প্রতিবাদ পাঠাই [ সারাংশ ] ঃ

“প্রিয় মুফতি ইব্রাহীম দেশাই,
পুত্রবধূকে শ্বশুরের লালসা-স্পর্শের ব্যাপারে আপনার রায় ভারতে সাম্প্রতিক ইমরানা ঘটনার মতো, বিবাহ বাতিল। এই কাজ করিয়া আপনি ইসলামের ওপরে প্রচণ্ড আঘাত হানিয়াছেন। আপনি কোরাণের সুরা নজ্ম ৩৮, ফা’তির ১৮ ও বাকারা ১৩৪ ও ১৪১-কে সরাসরি লঙ্ঘন করিয়াছেন যাহাতে আলাহ বলিয়াছেন কেহ অন্য কাহারো (অপ)কর্মের ফল বহন করিবে না। শতাব্দী ধরিয়া ইসলামের নামে এইসব ক্রাইম ঘটিতেছে। বর্তমানে বিশ্ব-মুসলিমের করুণ অবস্থার জন্য আপনার মতো ইসলামি নেতারা অনেকাংশে দায়ী। দয়া করিয়া মুসলিমদেরকে রেহাই দিন, আপনার ‘জ্ঞান’-এর শিকার এই সব নিরপরাধিনী ভুক্তভোগীর সামনে আলাহ- রসুল-কোরাণ ও ইসলামকে আর বিব্রত করিবেন না। আলাহ জানেন আপনার ফতোয়া কত শত নারীর জীবন ধ্বংস করিয়াছে।”

মুফতি কোন জবাব দেননি।

গাড়িটা কেমন সেইসাথে দেখতে হবে ড্রাইভারটা কেমন। এ-দু’টোর যে কোন একটা বিকল হলে দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। সেজন্য শারিয়া আইনগুলো এবং শারিয়াপন্থীদের মানসিকতা, এ দু’টোই খুব খেয়াল করে দেখতে হবে।

২০০৬ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর টাইম পত্রিকায় এক মারাত্মক খবর উঠেছে, সূত্রঃ http://www.time.com/time/world/article/0,8599,1537516,1600.html গোপন ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে সাংবাদিকরা বিখ্যাত মুফতিদের কাণ্ডকারখানা রেকর্ড ক’রে দেখান যে অনেক মুফতি টাকা খেয়ে ঘুষদাতার মতলব-মাফিক ফতোয়া জারি করছে। গ্রাম-গঞ্জের অখ্যাত ফতোয়াবাজ হলেও কথা ছিল, কিন্তু এর মধ্যে ভারতের সর্বোচ্চ এবং বিশ্ব-বিখ্যাত দেওবন্দি ইসলামি সংগঠন দারুল উলুম-এর মুফতিও আছে। এ ভিডিও টেলিভিশনে প্রচারিত হবার পর চারদিকে হৈ হৈ ও ধিক্কার পড়ে যায়। দারুল উলুম অন্ততঃ দু’জন মুফতিকে বরখাস্ত করেছেন। ইসলাম নিয়ে সৌদি আরবেও এ কালখেলার খবর ইণ্টারনেটে উঠেছিল। গত সৌদি বাদশাহ মারা গেলে প্রাসাদ-মুফতি ঘোষণা করেছিল কেউ যদি নতুন বাদশাহকে মেনে না নেয় তবে সে মুরতাদ ॥