shariakibole.com

লাব্বায়েক্ !

দুই ছেলে হজ্বে যাবে তাই নিয়ে মাহবুব সওদাগরের বাড়ি খুব ব্যস্ত। নূতন বিয়ে ওদের। এখনি সময় হজ্ব করার, পরে বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলে কঠিন হয়ে পড়বে। লোকে মনে করে হজ্বটা বুড়োবয়সের ব্যাপার − বড্ড ভুল ধারণা কারণ হজ্বে খুবই শারীরিক পরিশ্রম হয়। বড়ছেলে ছোটাছুটি করে জোগাড়যন্ত্র করছে কিন্তু ছোটকে নিয়ে মহা সমস্যা। ছোটবেলা থেকেই তার রহস্যের শেষ নেই, তার রঙ্গরসের পালায় পড়ে চিরকাল সবাই অস্থির। বাবা প্রস্তুতির কথা জিজ্ঞেস করলেই সে বলে, ‘হচ্ছে বাবা হচ্ছে, চিন্তা কোর না। এ-বছর যদি একজনের হজ্বও কবুল হয় তো আমারই হবে ইন্শা আল্লাহ্।’

বাবা আশ্বস্ত হন কিন্তু ছোটবৌ হয় না। তার বাবাও হজ্ব করেছে, সে জানে হজ্বে যেতে হলে কি হুলুস্থুল আয়োজন করতে হয়, কত জায়গায় কত ছোটাছুটি করতে হয়। সে দিব্যি দেখতে পাচ্ছে স্বামী তার কিছুই করছে না। মহা আরামে সে গা’ এলিয়ে আছে, যোগাড়যন্ত্রের কোন খবরই নেই। জিজ্ঞেস করলেই হেসে বলে, ‘আমারটা আমি করছি, তুমি তোমারটা গুছিয়ে নাও তো, শেষে তোমার জন্য দেরি না হয়।’ বৌ ত্রস্তে এটা-ওটা গোছায় কিন্তু মনে গেঁথেই থাকে সন্দেহটা। তার ওপর সেদিন স্বামী মাহবুব সওদাগরের কাছ থেকে হজ্বের নাম করে আরো এক লাখ টাকা চেয়ে নিল।

কেন নিল ?

তারপর একদিন বড় চলে গেল হজ্বের ক্যাম্পে বৌয়ের হাত ধ’রে। বাবা ছোটকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর হজ্ব-ক্যাম্প, ফ্লাইট, এসবের কিছুই তো বললি না।’ ছোট হেসে বলে, ‘ক্যাম্পে কেন যাব। বাড়ি থেকে সোজা হজ্বে যাব, ব্যবস্থা সবই হচ্ছে, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো তো বাবা।’

রওনা হবার দিন এল। বাবা বুকে জড়িয়ে দোয়া করলেন, মা অশ্র“সিক্ত চোখে ছেলে-বৌয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কি বললেন বুঝা গেল না। ড্রাইভার গাড়ির ডি¹ি’র মধ্যে স্যুটকেস পুরে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। মা’কে জড়িয়ে ধরে ছোট বলল, ‘মা, দশদিন পর ফিরে আসব। দোয়া কোর আর শুটকি রানড়বা করে রেখো।’ বাবা অবাক হলেন।

‘দশদিন পর ফিরবি ?’

‘ফিরব বাবা, কথা দিচ্ছি হজ্ব করেই ফিরব। ঠাট্টা নয় বাবা, সত্যি বলছি।’

বৌয়ের কানে গেল কথাটা। সে জানে দশদিনে হজ্ব করে ফেরা যায় না। কিন্তু সে এ’ও জানে স্বামী যে দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে কথাটা বলেছে নিশ্চিন্ত হয়েই বলেছে। যা বলেছে তা সে করবে। কিন্তু কি করে করবে ? এমনিতে স্বামী তাকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখে, তার সানিড়বধ্যে শক্তি পায় এগুলো নিয়ে মনে মনে তার ভারী স্বামীগর্ব। পেছনের সিটে বসল দু’জন, গাড়ি চলা শুরু করলে সে স্বামীর কানে কানে জিজ্ঞেস করে,

‘আমরা কোথায় যাচ্ছি গো ? হ্যাঁ ?’

‘কোথায় আবার, হজ্বে যাচ্ছি।’

‘এভাবে কেউ হজ্বে যায় ? আসলে কোথায় যাচ্ছি সত্যি করে বলো না !’

ছোট হেসে বলে, ‘হজ্বেই যাচ্ছি। সবুর করো, একটু পরেই দেখতে পাবে।’

বৌ খুব সবুর করল। তারপর আর পারল না। একটু পরে আবার বলল,

‘বাবার কাছ থেকে এক লাখ টাকা বেশি নিলে কেন ?’

ছোট আবারও হেসে বলল, ‘সবুর করো, সেটাও দেখতে পাবে।’

বৌ আবারও সবুর করল। গাড়ি এসে দাঁড়াল বাস স্টেশনে। বৌ বলল,

‘এ তো বাস স্টেশন !’

‘হ্যাঁ, বাস স্টেশনই তো !’

‘বাসে করে হজ্বে যাচ্ছি ?’

‘হ্যাঁ। পথে কিছু কষ্ট করতে হবে, পারবে তো ?’

‘আমরা হজ্বে যাচ্ছি না। বাসে করে কেউ হজ্বে যায় না। বাবাকে এভাবে ঠকালে ?’

‘কাউকে ঠকাইনি। এ-বছর যদি কারো হজ্ব কবুল হয় তো আমাদেরই হবে ইন্শা আল্লাহ্।

ওখানে গিয়ে বলবে লাব্বায়েক্।’

‘মানে কি ?’

‘লাব্বায়েক মানে হল আমি হাজির। অর্থাৎ হে আল্লাহ্, তুমি ডেকেছ, এই যে আমি হাজির হয়েছি।’

ড্রাইভার ডি¹ি থেকে স্যুটকেসগুলো বাসে তুলে দিয়ে মৃদুহেসে বলল,

‘আপনেরে হাজার সালাম সার। আপনেরে হাজার হাজার সালাম সার। অ্যাম্তেই ধীরে ধীরে মুসলমানের চৌক্ষু খুইলা দিব আল্লায়।

গম্ভীর স্বরে ছোট বলল,

‘সব রওনা হয়ে গেছে ঠিক মতো ? পরের এক লাখ টাকারটাও ?’

ড্রাইভার বলল, ‘হ সার। শ্যাষের চালান নিজের হাতে রওনা করাইয়া দিছি পরশু।’

এসব শুনে রমণীয় কৌতূহলের চাপে বৌয়ের অজ্ঞান হবার অবস্থা কিন্তু স্বামীকে মনে হচ্ছে অচেনা। ওই বুকে কি এক অস্থির ঝড় চলছে তা তার চোখ দেখলে বুঝা যায়। তার সদা-দুরন্ত কৌতুকময় চোখ দু’টো এখন যেন ফ্রেমে বাঁধা ঝড়ের ছবি। বাস চলা শুরু করলে বৌ বলল,

‘কোথায় যাচ্ছি আমরা ?’
‘রংপুর।’

‘রং−পু−র ?’ আঁতকে উঠল বৌ, − ‘রংপুর কেন ? ওখানে তো আমাদের কেউ নেই !’

স্বামী শক্ত করে চেপে ধরল বৌয়ের হাত । গভীর নিঃশ্বাসে শুধু বলল, ‘আমার হাত ধরে থাকো।’

এবার বৌয়ের হাতও আঁকড়ে ধরল স্বামীর হাত, বুঝল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে যা আগে কখনো ঘটেনি। বাস চলছে সাভার পার হয়ে। স্বামী হাতের ব্যাগ খুলে বের করল মাস খানেক আগের কিছু পুরনো খবরের কাগজ। মোটামুটি একই তারিখের এতগুলো কাগজ – বৌ যেন কিছু একটা বুঝেও বুঝতে পারছে না। আড়চোখে দেখল স্বামী কাগজগুলো একটা একটা করে খুলছে, সেইসাথে শক্ত দৃঢ় হয়ে আসছে তার চিবুক, ঠোঁটে শক্ত হয়ে চেপে বসছে ঠোঁট আর ঘন হয়ে আসছে তার নিঃশ্বাস।

দুপুরে রংপুরে বাস থেকে নেমে ঘটঘটে বেবিট্যাক্সীতে চেপে গ্রামের পথ। বিকেলে দূর গ্রামের কাছাকাছি আসতেই কানে এল জনতার হৈ হৈ। কাছে এসে বৌ দেখল দাঁড়িয়ে আছে চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ ভর্তি তিনটে ট্রাক। ট্রাকের ওপর থেকে তরুণ-কিশোরের দল মহা উৎসাহে ক্ষুধার্ত লোকজনের মধ্যে বিতরণ করছে চাল-ডাল আলু-লবণ আর পেঁয়াজ-মরিচ। ওড়নাটা কোমরে আচ্ছা করে পেঁচিয়ে মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিয়ে ট্রাকের ওপরে দাঁড়িয়ে তাদের নেত্রীত্ব দিচ্ছে পাড়ার আপামণি। তদারকিতে ব্যতিব্যস্ত গ্রামের মাতব্বর আর মসজিদের ইমাম। ভয়ঙ্কর
মঙ্গা দুর্ভিক্ষ চলছে উত্তরবঙ্গে, ক্ষুধার দাউ দাউ আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কোটি মানুষ।

চোখে শুকিয়ে যাওয়া অশ্র“ নিয়ে লুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে হাড্ডিসার শিশুকন্যা, হাড্ডিসার বালক। কঙ্কালসার মৃতদেহ রাস্তায় চিৎ হয়ে বীভৎস মুখে আকাশকে ভেংচি কাটছে। অন্য এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কে আতঙ্কিত ক্ষুধার্ত যুবতি − গত মঙ্গায় দু’টো নুন-ভাতের জন্য নোংরা ফড়িয়ার বিছানায় শরীর বিক্রি করার দুঃসহ স্মৃতি আবার তার সামনে কালনাগিনীর ছোবল তুলে এদিক-ওদিক দুলছে। অনাহার জর্জরিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অনাহার জর্জরিত নিরুপায় যুবক। খবরের কাগজে সে-সব পড়ছে আর ছবি দেখছে দেশের মানুষ কিন্তু চিনতে পারছে না। সরকারও চিনতে পারছে না। ওরা এ দেশের নয়। ওরা পরিত্যক্ত, ওদের কেউ নেই।

পলকের জন্য টলে উঠল বৌয়ের মাথার ভেতর।

কিন্তু এখন জনতার ক্ষুধিত আর্তনাদ বদলে হয়েছে উৎসবের চিৎকার। বৌ মুগ্ধ চোখে দেখল মানুষের আনন্দ, তারপর দুষ্টুমি করে বলল, ‘ও ! হজ্বের টাকায় দান-ধ্যান হচ্ছে তাহলে ?’

‘দান ?’ চকচক করে উঠল স্বামীর দু’চোখ − ‘কিসের দান ? কাকে দান ? আশরাফুল মাখলুকাত ওরা, আপাতত একটু কষ্টে পড়েছে। আমি তো শুধু উপহার দিচ্ছি, মানুষের প্রতি মানুষের উপহার।’

মুগ্ধ বৌয়ের মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, ‘তুমি একটা ফেরেশতা।’

‘না। আমি ফেরেশতার চেয়েও বড়, আমি বনি আদম। কোরাণ পড়ে দেখ।’

তারপর স্বামী তার সেই পুরনো পরিচিত দুষ্টুমিভরা চোখে বলল, ‘আসলে কি জানো ? ব্যবসায়ীর ছেলে জাত-ব্যবসায়ী তো আমি। উপহারের নামে আমি আসলে ব্যবসা করছি। ধারের ব্যবসা − স্স্স্স্ … কাউকে বলো না যেন !’

‘ধারের ব্যবসা ? এই দুর্ভিক্ষের দেশে ?’

বিস্ময়ে বৌয়ের কথা আটকে গেল গলায়। বাক্চাতুরিতে আর দুষ্টুমিতে স্বামী তার অনন্য, কিন্তু একের পর এক এত বিস্ময়ের ধাক্কা সে আর সামলাতে পারছে না। ‘কিসের ধার ? কাকে ধার ?’

‘বুঝলে না ? আল্লাকে ধার দিচ্ছি, প্রচুর লাভ হবে বৌ, গ্যারাণ্টিড। !’

‘আল্লাকে ধার দিচ্ছ ? তওবা তওবা !’

‘তওবা মানে ? আল্লা তো নিজেই আমাদেরকে ডেকে ডেকে ধার চাচ্ছেন !’

‘আল্লা ডেকে ডেকে ধার চাচ্ছেন ? তওবা তওবা !’

‘কিসের তওবা বৌ ? খুলে দেখ কোরাণ শরীফ -“এমন কে আছে যে আল্লাহকে দেবে উত্তম কর্জ, আর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ বহুগুণ বেশি করে দেবেন।” ’

‘কি বললে ? আবার বলো তো ??’

“এমন কে আছে যে আল্লাহে ক দেবে উত্তম কর্জ, আর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ বহুগুণ বেশি করে দেবেন” − সুরা বাকারা ২৪৫।

‘কি আশ্চর্য !! এই দুর্ভিক্ষের সময়ে কেউ কোরাণের এ-কথা দেশের সবাইকে বলে না কেন ?’

‘বলা দরকার, রেডিও-টিভি-খবরের কাগজ, সব জায়গায় বলা দরকার। ঢাকায় ফিরেপড়ে দেখো সুরা হাদীদ আয়াত ১১, সুরা মুয্যাম্মিল আয়াত ২০ আর আত্ তাগাবুন আয়াত ১৭ − “আল্লাহে ক উত্তম ঋণ দাও … যদি তোমরা আল্লাহেক উত্তম ঋণ দাও তিনি তোমাদের জন্য তা দ্বিগুণ করে দেবেন।” এই দশ ট্রাকের ধার দিচ্ছি, রোজ হাশরে বিশ ট্রাকেরও বেশি সওয়াব পাব। তার সবটাই তোমাকে দিয়ে দেব যাও !’

হেসে ফেলল বৌ – মনে মনে আবার স্বামীগর্বে গরবিনী হল সে। ছোটকে দেখে ছুটে এল মাতবর আর ইমাম, অনেক কথা হল তাদের মধ্যে। বৌ মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগল মানুষের আনন্দ। ক্ষুধার্তের মুখে অনড়ব তুলে দেবার মতো আনন্দ আছে ? ক্ষুধার্তের মুখে অনড়ব তুলে দেবার মতো ইবাদত আছে ? দিগন্তে তখন সূর্য ডুবুডুবু, মন্দ মন্থরে সন্ধ্যা নামছে। চমক ভাঙল যখন স্বামী এসে বলল ঃ

‘জানো, আমার দেখাদেখি অন্যেরাও কিছু পাঠাচ্ছে।’

‘আমার কিছু গয়না আছে। তা থেকে কিছু নাহয় …।’

‘আচ্ছা, খূব ভালো হবে। এই না হলে আমার বৌ ! অন্য ট্রাকগুলো অন্যান্য গ্রামে গেছে − কাল আমরা সেসব জায়গায় যাব। আমি চাই আমার বৌ নিজের হাতে খাবার বিলোবে আর বাচ্চাদের কোলে বসিয়ে মুখে তুলে খাওয়াবে। ক্যামেরা এনেছি, তোমার বাচ্চা-খাওয়ানোর ছবি তুলব।’

‘না, ছবি তুলবে না।’

‘কেন ? ছবি তুলবে না − আশ্চর্য মেয়েমানুষ তুমি !’

‘এ-সব ছবি তারাই তোলে যারা পত্রিকায় ছাপে প্রচারের জন্য। ছবি তুললে তোমারও সেই ইচ্ছে হবে।’

‘তথাস্তু। প্রচারের জঞ্জাল আমাদের দরকার নেই, ছবি ক্যান্সেল। যা হোক, রাতটা

কাটাতে হবে ইমাম বা মাতবরের বাসায়, তোমার কষ্ট হবে না তো ?’

‘না, কষ্ট হবে কেন।’

‘শোন। মন দিয়ে শোন।’

বৌ মন দিয়ে শুনল, − এত মন দিয়ে সে কোনদিনই কারো কথা শোনেনি। অশরীরী এক দৃঢ়কণ্ঠে স্বামী ফিসফিস করে উঠল − ‘আমাদের ঘরে দানাপানি থাকা পর্যন্ত মানুষের বাচ্চাকে না খেয়ে মরতে দেব না আমি।’

কথাগুলো যেন বৌ-এর কল্জের ভেতরে ঢুকে গেল − শিউরে কাঁটা দিয়ে উঠল তার শরীর। স্বামীর হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘মঙ্গা ফি’বছর থাকবে না। মানুষ আবার উঠে দাঁড়াবে, ফসল ফলাবে, আবার দু’বেলা দু’মুঠো খেয়েপরে ভালই থাকবে। তখন আবার আমরা হজ্ব করতে যাব।’

‘‘নিশ্চয়ই, অবশ্যই, ইন্শা আল্লাহ্। হজ্বের তো বিকল্প নেই, সামনে বছরের বুকিং আমি দিয়েই এসেছি।’

সুদৃঢ় কঠিন পদক্ষেপে স্বামী চলে গেল ট্রাকের কাছে। সামনে ধু-ধু খরা বন্ধ্যা জমি − ওপরে অবারিত আকাশ। ঝোপের ডালে উড়োউড়ি করছে একটা ফড়িং, মাটিতে ঘোরাঘুরি করছে নামহীন দু’টো পোকা আর পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে একদল পিঁপড়ে। কি যেন কি নিয়ে ওরা সবাই খুব ব্যস্ত।

কোনদিন কি কোন পিঁপড়ে না খেয়ে মরেছে ? কোন ফড়িং বা পোকা ?

বৌ কল্পনায় দেখল এয়ারপোর্টে দুধ-রং ধবধবে সাদা কাপড়ে হাজার হাজার আনন্দিত হজ্বযাত্রী হুড়োহুড়ি করে প্লেনে উঠছে আর বুকভরা তৃপ্তিতে বলছে শুকুর আল্ হামদুলিলাহ !! ওদিকে দূরে দাঁড়িয়ে ছোট্ট দু’টো ক্ষুধার্ত ভাই-বোন হাত ধরাধরি করে করুণ চোখে তা দেখছে। ভাইটা আস্তে করে বলল − ‘বড় হইয়া ত’রে হজে লইয়া যামু।” দ্বিধাগ্রস্ত ছোট্ট বোনটা কি যেন ভাবল। তারপর ফিসফিস করে যেন নিজেকেই প্রশড়ব করল − “ওইহানে ভাত আছে ?”

পলকের জন্য আবারও তার মাথাটা টলে উঠল।

মায়াময় প্রামবাংলার প্রান্তে নেমে আসছে গ্রামবাংলার মায়াময় সন্ধ্যা। চমক ভাঙল যখন পেছন থেকে স্বামী এসে তার হাত ধরল। বৌ চোখ তুলে দেখল স্বামীর দু’চোখে জ্বলছে হাজার জোনাকি। সেই চোখ বৌয়ের দু’চোখে গেঁথে স্বামী বলল, ‘জানো, নবীজী বলেছেন যার প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে সে মুসলমান নয়। যে মুসলমানই নয় তার আবার হজ্ব কি ?’

তারপর বৌয়ের হাত ছেড়ে সে থমকে দাঁড়াল। পুরো নিঃশ্বাস বুকের ভেতরে টেনে একটু আটকে নিল যেন। তারপর দু’হাত সোজা ওপরে তুলে আকাশের দিকে মুখ তুলে সর্বশক্তিতে চিৎকার করে উঠল − ‘লাব্বায়েক … !!’

বৌয়ের ভেতরটা কেঁপে উঠে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্র“ধারা, মুখ দিয়ে অস্ফূটস্বরে বের হল − “লাব্বায়েক ! লাব্বায়েক !!”

সুদূর পশ্চিমে দিগন্তবিস্তৃত মরুকেন্দ্রে তখন কাবা শরীফের চারধারে জলদমন্দ্রে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে লক্ষ কণ্ঠের আকুতি − “লাব্বায়েক … !!”