shariakibole.com

শারিয়াপন্থীদের যুক্তি

এধরনের আলোচনায় যেহেতু সদ্ভাবে, নৈর্ব্যক্তিকভাবে এবং আবেগহীনভাবে সবগুলো দিকই দেখতে হয়, তাই এবারে চলুন আমরা দেখি শারিয়াপন্থীদের যুক্তি কি।

সবচেয়ে ভাল হত যদি শারিয়াপন্থীদের সাথে আমাদের দলিলভিত্তিক আলোচনার ভিডিও জাতির সামনে তুলে ধরা যেত। দেশে বিদেশে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছি আমরা কিন্তু তাঁরা আলোচনায় রাজি নন। যাহোক, তাঁদের যুক্তিগুলো ধরা আছে শারিয়াপন্থী ওয়েবসাইটগুলোতে, হিজবুত তাহরীর-মুসলিম ব্রাদারহুড-জামাতের মত শারিয়াপন্থীদের গঠনতন্ত্রে, বান্না-কুতুব-মওদুদি-কারজাভী-বাদাওয়ি-খোমেনির মত শারিয়া নেতাদের বই-বক্তৃতায় এবং শারিয়া কেতাবগুলোর মুখবন্ধে। এ-যুক্তির সমর্থনে তাঁরা চমৎকার শব্দ ব্যবহার করেন, যেমন নবীজীর প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্র, খুলায়ায়ে রাশেদীনের পরিচালিত ইসলামি রাষ্ট্র, আল্লার আইন, সামগ্রিক জীবন-বিধান, বিশ্ব-মুসলিম ভ্রাতৃত্ব, ইসলামি মূল্যবোধ, ইসলামি সমাজের অনাবিল সুবিচার ও শান্তি, নবীজীর সুনড়বতের অনুসরণ, কোরাণ-হাদিসভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা, সৎলোকের শাসন, ইসলামি সভ্যতা, ইসলামি কৃষ্টি ও ঐতিহ্য, ইসলামি অর্থনীতি, ইত্যাদি। ভক্ত মুসলমানের মনে এই শব্দগুলোর সম্মোহন-শক্তি হ্যামিলনের বাঁশির চেয়েও প্রবল। কষ্টকর জীবনের চাপে বিপর্যস্ত, অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মুসলিম সমাজে এসব শব্দ প্রচণ্ড ধর্মীয় আবেগের সঞ্চার করে ও মোহময় আশার আলো জাগায়। দুর্নীতিপরায়ণ ও অকর্মণ্য রাজনৈতিক দলগুলোর পালায় পড়ে দেশের আজ অসম্ভব দুরবস্থা − জনগণের কষ্টের শেষ নেই। এই কষ্টের অবসান করার আশায় মানুষ মনে মনে চলে যায় মায়াময় একটা চমৎকার স্বপড়বীল দুনিয়ায় যা ইহকাল-পরকালে সবদিক দিয়ে সফল। অনতিক্রম্য এ স্বপেড়বর আকর্ষণ, দুর্বার এর হাতছানি। তাঁদের যুক্তি ও কোরাণ-হাদিসের সূত্রগুলো সর্বদা একই, তবে সেগুলো আমি দেখাব অন্য এক নিবন্ধ থেকে। ২০০৩-২০০৫ সালে টরণ্টো শারিয়া কোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সময় আমরা অনেক হুমকি পাই, এমনকি টেলিফোনের অ্যান্সারিং মেশিনে মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেসের কমিটি-সদস্যদেরকে জবাই করার হুমকিও ছিল। এ নিয়ে কাগজে লেখালেখি পুলিশ তদন্ত হয়েছে, হুমকিদাতা ধরা পড়েনি। তখন আমি হুমকি সহ একটা বিশাল নিবন্ধ পাই। এটা ছিল মওদুদি-খোমেনির চেয়ে অনেক বেশি সুলিখিত। সেখান থেকে তাঁর হুমকি বাদ দিয়ে যুক্তিগুলো দেখাচ্ছি।

তার আগে সংক্ষেপে ক্যানাডিয়ান শারিয়া কোর্টের কথাটা বলা প্রয়োজন। পশ্চিমা দেশগুলোর আইনে শারিয়ার কিছু আইন ঢোকানোর চেষ্টা শারিয়াপন্থীরা করছেন অনেক আগে থেকেই, ক্যানাডিয়ান শারিয়া কোর্ট ছিল তাঁদের চূড়ান্ত সাফল্য। বহু মামলা জমে যাবার ফলে ক্যানাডার অণ্টারিও প্রদেশের সরকার ১৯৯১ সালে ধর্মীয় কোর্টগুলোকে পারিবারিক ও ব্যবসায়িক মামলা নিষ্পত্তি করার অধিকার দিয়ে আইন পাশ করে। সাথে সাথে শারিয়া কোর্ট, ইহুদি কোর্ট ইত্যাদি বানানো হয় কিন্তু আমরা কিছুই জানতাম না। দীর্ঘ তেরো বছর ধরে মামলা নিষ্পত্তি করার পর ২০০৩ সালে শারিয়া কোর্ট সরকারের কাছে আবেদন করে আর্বিট্রেশন স্ট্যাটাসের জন্য। এটা পেলে শারিয়া কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ক্যানাডার কোর্টে আপিল করা যেত না। অর্থাৎ, তাঁরা একই দেশে সমান্তরাল দু’টো বিচার ব্যবস্থা চেয়েছিলেন। এ-খবর ফাঁস হ’লে ক্যানাডিয়ানরা উদ্বিগড়ব হয়ে পড়ে। আমি শারিয়া কোর্টের কাছে দু’বার চিঠি পাঠাই কিছু মামলার বিবরণ (স্বামী-স্ত্রীর নাম-ধাম গোপন রেখে) এবং যে শারিয়া আইনগুলো তাঁরা প্রয়োগ করেছেন তা পাঠাতে যাতে আমরা বুঝতে পারি মুসলিম-নারীরা সুবিচার পাচ্ছেন কিনা। তাঁরা জবাব দেননি। তখন মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেস, ক্যানাডিয়ান কাউন্সিল অব্ মুসলিম উইমেন, এবং ইণ্টারন্যাশনাল মুভমেণ্ট এগেন্সট্ ক্যানাডিয়ান শারিয়া কোর্ট, এই তিনটে ছোট দল ওই শারিয়া কোর্টের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলনে নেমে পড়ে। মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেসের ডিরেক্টর অব্ শারিয়া ল’ হিসেবে আমার সুযোগ হয়েছিল এ-সংগ্রামের প্রথম সারিতে থাকার। প্রবল পরাক্রান্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রুদ্ধশ্বাসে এ সংগ্রাম চলেছে। আমাদের অক্লান্ত আন্দোলনের ফলে সরকার ২০০৫ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে নূতন আইন ক’রে সব ধর্মের কোর্টকে উচ্ছেদ করার ঘোষণা দেয়। যদি এটা না হতো, যদি আমরা হেরে গিয়ে এই শারিয়া কোর্ট টিকে থাকত তবে মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত শারিয়াপন্থীরা প্রগতিশীল মুসলমানদের নাকের ডগায় এই ক্যানাডিয়ান শারিয়া কোর্টের উদাহরণ তুলে ধরে বলত ঃ ‘ক্যানাডার মত দেশ তাদের আইনের চেয়ে ভালো বলেই তো আল্লাহ’র আইন প্রয়োগ করেছে।’ এর কোন জবাব ছিল না প্রগতিশীল মুসলমানদের। সেদিক দিয়ে বিশ্ব-মুসলিম এক ভয়াবহ অবস্থা থেকে বেঁচে গেছে।

এবারে শারিয়াপন্থীদের সূত্র ও যুক্তিতে আসি। তাঁর বিশাল নিবন্ধ থেকে দরকারি অংশটুকু ভাবানুবাদ করে তুলে ধরছি।

* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *

ইসলামের একটি রাজনৈতিক রূপ আছে এবং তাহা কোরাণ-রসুল দ্বারা সমর্থিত ও নির্দেশিত। ইহার কারণগুলি হইল ঃ-

১। এই দুনিয়া আল্লা হ’র সৃষ্টি ও সম্পত্তি।

২। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলেই তাঁহার দাস। কেহ কেহ ইচ্ছাকৃত দাস (মুসলিম) যাহারা তাঁহার মালিকানা মানিয়া লইয়াছে, এবং বাকিরা বিদ্রোহী দাস যাহারা তাঁহার মালিকানা অস্বীকার করে ও তাঁহার অবাধ্য। অবশ্য ইহাতে তাহাদের দাসত্বের হেরফের হয় না, তাহারা বিদ্রোহের জন্য শাস্তিযোগ্যই থাকে।

৩। যেহেতু আল্লাহ স্রষ্টা তাই তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন সৃষ্টির সর্বাপেক্ষা মঙ্গল কিসে। তাই তাঁহার আইন মানুষের বানানো যে-কোনো কিছু হইতে উন্নত।

৪। যেহেতু স্রষ্টার জ্ঞান সৃষ্টির জ্ঞানের চেয়ে উন্নত তাই আমরা কোনদিনই আল্লাহ অপেক্ষা বেশি জানিব না। সেই কারণেই তাঁহার আইন মানিয়া চলাতেই মানুষের মঙ্গল নিহিত। আল্লাহ যাহা নিষেধ করিয়াছেন (পরকীয়া, সমকামীতা, জুয়া, সুদ, মদ্যপান ইত্যাদি) তাহাকে বৈধ করার মধ্যে কল্যাণ নাই।

৫। আল্লাহ সকল নবী-রসুলকে একই উদ্দেশ্যে পাঠাইয়াছেন – যাহা কিছু মঙ্গল তাহা বৈধ করা ও পালন করার আদেশ দেওয়া, এবং যাহা মন্দ তাহাতে বারণ করা।

৬। নবীদের প্রত্যেকে আল্লাহ’র আইন আনিয়াছেন পালন করিতে, প্রচার করিতে ও শক্তির সাথে প্রয়োগ করিতে (to enforce it)।

৭। সুতরাং তাঁহারা ঘটনাক্রমে বা দৈবাৎ কিছুই করেন নাই। তাঁহারা যাহাই করিয়াছেন তাহা প্রকৃতপক্ষে তাঁহাদের কর্তব্য ঠিকমত করার যোগ্যতা হাসিলের জন্য আল্লাহ’র পরিকল্পনা মাফিকই করিয়াছেন। আল্লাহ’র ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না।

৮। একদিন আমাদিগকে আল্লাহ’র নিকট ফিরিয়া যাইতে হইবে এবং আমাদের কর্মের জবাব দিতে হইবে।

মানবসভ্যতা এখন পার্থিব চরম উন্নতি সত্ত্বেও আধ্যাত্মিক দিক দিয়া দেউলিয়া হইয়া উদ্ভান্ততা ও অর্থহীনতায় ভুগিতেছে। খুবই পরিতাপের বিষয় যে ইহার সমাধান (অর্থাৎ শারিয়া-আইন − লেখক) যাহাদের কাছে আছে তাহাদেরই একটি অংশ (অর্থাৎ শারিয়া আইন-বিরোধী মুসলমানেরা − লেখক) সেই সমাধানকে কাজে লাগাইবার ব্যাপারে বাধা দিতেছেন।

মানুষের দুইটি মূল প্রয়োজন আছে – পার্থিব ও আধ্যাত্মিক। শুধুমাত্র ইসলামই ইহা দিতে পারে। কেননা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আবিষ্কার করিয়াছে যে শুধুমাত্র ইসলামের কোরাণ সুন্নতই বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ আগের ধর্মগ্রন্থগুলিকে এমনভাবে বিকৃত করা হইয়াছে যে ঐগুলি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সাথে মিলে না। ফলে, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরা স্রষ্টার দেওয়া ধর্মগ্রন্থগুলিকে বর্জন করিয়াছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও নাস্তিকতার জন্ম হইয়াছে। কিন্তু ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষ নহে কারণ ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হইল জীবনযাপনে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্রষ্টার অনুপস্থিতি। মুসলমানের প্রতিটি সিদ্ধান্তে আল্লাহ’র উপস্থিতি এবং তাঁহাকে খুশি করাই মূল কথা। যখন কোন মুসলমান আল্লাহ’র ইচ্ছামাফিক জীবনযাপন করে তখন ইহকাল-পরকালে কল্যাণ হয়।

ইসলামের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধেও একই কথা বলা যায়। গায়ের রং, গোত্র, লিঙ্গ কিংবা কোনকিছুরই ভিত্তিতে ইসলাম নারীর বা কাহারো বিরুদ্ধাচারণ করে না। ন্যায়বিচার, সাম্য ও কল্যাণ হইল ইসলামের রাষ্ট্র-ব্যবস্থার ভিত্তি। বিজ্ঞাপন, তদবির বা ভোটের সংখ্যা দ্বারা ইহার এদিক-ওদিক করার উপায় নাই। ইসলাম ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী যখন তাহা অন্যের বা জাতির অধিকার লঙ্ঘন করে। ইসলাম গুরুত্ব দেয় দায়িত্বের উপর, বিশেষ করিয়া নেতাদের দায়িত্বের উপর যাহাতে শুধু মুসলমান নয় বরং সকলের মঙ্গল হইবে। বহু-সংস্কৃতি ও বহু-ধর্মের সমাজে অমুসলিমের অধিকার ও তাহাদিগকে সার্বিকভাবে রক্ষা করা ইসলামি রাষ্ট্রের কর্তব্য। এই পরিপ্রেক্ষিতেই অমুসলিমেরা যদি চায় তবে দেশরক্ষার যুদ্ধে না-ও যাইতে পারে। ইহা একটা সুবিধা যাহা শুধু অমুসলিমদিগকেই দেওয়া হইয়াছে। ইসলামি রাষ্ট্রে তাহাদের উপাসনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে, উপাসনালয়গুলি সুরক্ষিত এবং তাহারা সকল রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার অধিকারী। ইসলাম কোন বাদশাহের বাদশাহী প্রতিষ্ঠা করিতে চায় না। ইসলাম চায় আল্লাহ’র সৃষ্ট সমস্ত জমিতে (যাহা তাঁহার সম্পত্তি) তাঁহার সৃষ্ট সকল মানুষের উপর তাঁহারই আইন প্রয়োগ করিতে। তাই ইসলামি রাষ্ট্রে ইসলামি আইন প্রয়োগ হইবে ইহাই ইসলামের রাজনৈতিক চরিত্র।

১। সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহ’র। তাই সমস্ত সৃষ্টিকে আল্লাহ’র দেয়া বিধিবিধান আইন মানিয়া চলিতে হইবে।

২। রসুলকে আল্লাহ অধিকার দিয়াছিলেন সামাজিক আইন দিবার − সূত্র আরাফ ১৫৭, তাওবা ২৯, আহযাব ৩৬, হাশর ৭, নূর ৪৭-৫২ ইত্যদি।

৩। রসুল হইলেন আল্লাহ’র মুখপাত্র। তাই রসুলকে মান্য করিতেই হইবে এবং তাঁর বিচার মানিয়া লইতে হইবে। যেহেতু রসুলের প্রতি আনুগত্য আল্লাহ’র প্রতি আনুগত্য, তাই রসুলের প্রতি অবাধ্যতা আল্লাহ’র প্রতি অবাধ্যতা যার অর্থই হল জাহান্নাম − সূত্র মায়েদা ৪৪-৫০, নিসা ১৪, ১৫, ৬৪, ৮০, আহযাব ৩৬, জ্বিন ২৩, আনফাল ১৩, তওবা ৬৩ ইত্যাদি।

৪। রসুলের অনুগত না হইয়া আল্লাহ’র অনুগত হইবার উপায় নাই এবং আলাহেক সামনাসামনি পাওয়া যাইতেছে না তাই রসুলের অনুগত হওয়াই যথেষ্ট − সূত্র নূর ৫৪, ৫৬, নিসা ৪২, ১১৫, আশ শুরা ৫১, নজ্ম্ ৩ ইত্যাদি।

৫। ১৫শ’ শতাব্দীর হিউগো গ্রোটিয়াসকে আন্তর্জাতিক আইনের পিতা ধরা হয়। কিন্তু তাঁহার প্রায় আটশ’ বছর আগে মুহম্মদ বিন আল্ শায়বানী ইসলামি আন্তর্জাতিক আইনের রূপরেখা দিয়াছেন তাঁহার কিতাব ‘কিতাবুল সিয়ারুল কবির’-এ।

৬। ১৯৪২ সালে ডঃ হামিদুলাহ মদিনার গঠনতন্ত্র নিয়া লিখিয়াছেন ‘দ্য ফার্স্ট রিটন কন্সটিটিউশন ইন্ দ্য ওয়ার্লড’ অর্থাৎ ‘বিশ্বের প্রথম লিখিত গঠনতন্ত্র।’

ইহা সুস্পষ্ট যে শুধু আমাদের রসুল নহেন বরং আগেকার নবী-রসুল যেমন মুসা (আঃ)-কে আল্লাহ আইন দিয়াছিলেন যাহা প্রয়োগ করা তাঁহাদের দায়িত্ব ছিল। ইহা ইসলামের রাজনৈতিক চরিত্র ছাড়া আর কি ? লক্ষণীয় যে, কোরাণ যখনই আল্লাহ’র প্রতি অনুগত থাকার কথা বলিয়াছে তাহার পরে সর্বদাই আমাদের রসুলের প্রতি অনুগত থাকার কথা বলিয়াছে। অপরপক্ষে, কিছু আয়াতে শুধু রসুলের প্রতি অনুগত থাকার কথা বলা হইয়াছে কিন্তু আল্লাহ’র প্রতি আনুগত্যের কথা নাই। রসুলের প্রতি আনুগত্যকে এত গুরুত্ব দিবার কারণ হইল রসুলের প্রতি আনুগত্য ছাড়া আল্লাহ’র প্রতি আনুগত্য করা সম্ভব নহে কারণ আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের সাথে কথা বলেন না (সূত্র আশ শুরা ৫১)। কাজেই যখন কোন রসুল কিছুকে বৈধ বা অবৈধ করেন তখন আল্লাহ’র রসুল হিসোবেই করেন। সুরা নিসা ৮০ ও নজ্ম্ ৩ অনুসারে রসুলের প্রতি আনুগত্যই আল্লাহ’র প্রতি আনুগত্য, রসুলের প্রতি আনুগত্য ছাড়া আল্লাহ’র প্রতি আনুগত্য অসম্পূর্ণ। তাই আল্লাহ কোরাণে উলেখ না থাকিলেও রসুলের কথা এবং কর্মকে সম্পূর্ণভাবে পালনের জন্য বৈধ করিয়াছেন।

হজরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর একটি কর্তব্য ছিল ভালকে ভাল ও মন্দকে মন্দ ঘোষণা করা। আইনদাতা হিসেবে তাঁহার আরেকটি কর্তব্য ছিল আইনগতভাবে ভালকে বৈধ এবং মন্দকে অবৈধ করা (আল্ আরাফ ১৫৭)। এই দুইটি কর্তব্যে তফাৎ হইল প্রথমটি শুধু প্রচার এবং দ্বিতীয়টি হইল আইন বানানো ও প্রয়োগ। এই আয়াতে রসুলকে সেই সব আইনও বানাইবার ও প্রয়োগের অধিকার দেওয়া হইয়াছে যে আইন কোরাণে নাই। তাই ইহা কিছুতেই বলা যাইতে পারে না যে আইন শুধুমাত্র কোরাণই দিবে। আয়াতটিতে রসুলের উপর মানুষের বিশ্বাসকেও প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে। অর্থাৎ কোন কিছুকে আইনগতভাবে বৈধ বা অবৈধ করা সহ তাঁহার প্রতিটি কাজের প্রতি বিশ্বাস থাকিতে হইবে। এই আয়াতে নূরকে অনুসরণ করিতে বলা হইয়াছে অর্থাৎ কোরাণের মাধ্যমে এবং কোরাণের বাহিরেও তাঁহার আদেশ মানিতে বলা হইয়াছে। ইহাও বলা হইয়াছে − “তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর তাহলে কিতাবের ঐ লোকদের সাথে যাহারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না, আল্লাহ ও তাঁহার রসুল যাহা হারাম করিয়াছেন তাহা হারাম করে না।” ইহাতে বুঝা যায় কোন কিছুকে হারাম করিবার অধিকার আল্লাহ’র সহিত আল্লাহ’র প্রদত্ত অধিকারের বলে রসুলেরও আছে। অর্থাৎ আল্লাহ ও রসুল একত্রে বা আলাদাভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ও কেহ তাহা অমান্য করার অধিকার রাখে না।

আসাদ গোত্রের এক নারী আবদুলাহ ইবনে মাসুদ-এর নিকটা আসিয়া বলিল − ‘আমি শুনিলাম আপনি এই এই জিনিসকে অবৈধ বলেন। আমি আল্লাহ’র কেতাব পড়িয়াছি কিন্তু তাহাতে উহা পাই নাই।’ আবদুলাহ ইবনে মাসুদ বলিলেন − ‘তুমি যদি কেতাবটি (ঠিকমত) পড়িতে তবে তাহা পাইতে। আল্লাহ বলিয়াছেন ঃ ‘রসুল যাহা কিছু দেন তাহা গ্রহণ কর এবং যাহা নিষেধ করেন তাহা হইতে বিরত থাক’ (আল্ হাশর ৭)। রসুল স্পষ্টতই বিচারকের বেশিই ছিলেন। কেননা রায় দিবার অধিকার বিচারকের অবশ্যই আছে এবং তাহা সকলে মানিতে বাধ্য কিন্তু তাঁহার রায়ের প্রতি মানসিক অনুগত না থাকিলে গুনাহও হয় না এবং মুসলমানও থাকা যায়। কিন্তু রসুলের ক্ষেত্রে তাহা নহে। রসুলকে বিচারক না মানিলে কিংবা তাঁহার বিচারকে খুশি মনে না মানিলে মুসলমানই থাকা যাইবে না (নিসা ৬৫, নূর ৪৭-৫২)।

ইহা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে দুনিয়ার সৎ মুসলমান ও সৎ অমুসলমানেরা নিরপেক্ষভাবে পরীক্ষা করিয়া দেখুক মানবজাতিকে ইসলামের কি দিবার আছে। তাহা হইলে দেখা যাইবে যে-সকল বিষ বর্তমান বিশ্বকে বিষাক্ত করিতেছে তাহার সমাধান একমাত্র ইসলামেই আছে। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে আমরা যে-সকল সমস্যার সম্মুখীন হইতেছি তাহার মূল কারণ হইল আল্লাহ’র ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন অপেক্ষা মানুষের ব্যক্তিগত লোভ ও লালসা বড় হইয়া গিয়াছে। মানুষ তখনই ইহা করে যখন সে মনে করে কাহারও কাছে তাহাকে জবাবদিহি করিতে হইবে না। ইসলাম এই ধারণাকে নস্যাৎ করিয়া দেয়। নবী-রসুলদিগকে পাঠাইবার উদ্দেশ্য ছিল না শুধু কিভাবে ইবাদত করিতে হয় তাহা দেখানো কিংবা বেহেশ্ত- দোজখের খবর দেওয়া। সে-উদ্দেশ্য ছিল প্রচার ও ব্যক্তিগত উদাহরণ দিয়া দেখাইয়া দেওয়া কিভাবে জীবনযাপন করিলে ইহকাল পরকালে মঙ্গল হইবে। ইসলাম শুধু ইবাদতের কিছু আনুষ্ঠানিকতা কিংবা ভাল ব্যবহারের কিছু এলোপাথাড়ি নির্দেশ নহে। যিনি আমাদের জীবন দিয়াছেন ও বিশ্ব-নিখিল সৃষ্টি করিয়াছেন তাঁহার ইচ্ছা মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার ইহা একটি সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ বিধান।

মানি বা না মানি আমরা আল্লাহ’র কাছে জবাব দিতে বাধ্য। যদি আমরা পরস্পরের উপর দায়িত্বশীল হইয়া জীবনযাপন করি তবে সকলের মঙ্গল হইবে। না হইলে বর্তমান অবস্থা চলিতে থাকিবে যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে একটি দেশ অন্য দেশকে নিপীড়ন করে ও তাহার প্রাকৃতিক সম্পদ হরণ করে। সবাই জানে পতিতাবৃত্তি, সমকামীতা, জুয়া ও মদ্যপান ক্ষতিকর কিন্তু তবুও এগুলিকে বৈধ করা হইতেছে। স্বাধীনতার নামে নারীকে যৌনবস্তুতে পরিণত করা হইতেছে। সুদ-ভিত্তিক অর্থনীতি গরিবি বাড়াইয়া ধনীকে আরো ধনী করিতেছে। দুনিয়াতে গোত্র, বর্ণ, জাতীয়তা ও নারী-পুরুষের ভিত্তিতে বৈষম্য রহিয়া গিয়াছে। জীবনের উন্নতির নির্লজ্জ বাহানায় একটি দেশ জবরদস্তি করিয়া পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করিতেছে। এই অবস্থায় চুপ করিায় থাকাও অপরাধ। যাহা দিয়া এইগুলিকে ঠিক করিয়া ন্যায়বিচার, সাম্য, বৈষম্যহীনতা, আল্লাহ’র প্রতি জবাবদিহিতা ও তাঁহার কাছে ফিরিয়া যাওয়ার ধারণা প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহাকে ইচ্ছা করিয়া লুকাইয়া রাখা হইল সবচাইতে বড় অপরাধ।

আল্লাহ’ই সবচাইতে ভাল জানেন।

* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *

শারিয়াপন্থীদের সূত্র ও যুক্তি শেষ হল। এ-কথা মানতেই হবে যে যা বলা হয়েছে এবং যেভাবে তা বলা হয়েছে তা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ভক্ত মুসলমানের মনে এর আবেদন অত্যন্ত শক্তিশালী। বলা বাহুল্য কোন মুসলমান এর কোনটাতেই দ্বিমত করবে না। কারণ সূত্রগুলো আসলেই সত্যি। কিন্তু সত্যি হলেও অসম্পূর্ণ। কারণ এ-বিষয়ের সাথে বাস্তবতা ও ঐ কোরাণ-রসুলেরই অন্যান্য সংশিষ্ট সূত্রগুলো ধরা হয়নি। সেগুলো একসাথে করলে পুরো চিত্রটাই বদলে যাবে। অসম্পূর্ণ সত্য পুরো ধর্মটাকেই উল্টিয়ে দিয়ে কি সাঙ্ঘাতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে এটা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সে-কারণেই এই মতামত ও বিশ্লেষেণর সাথে অতীত-ভবিষ্যতের বহু মুসলমানেরাই একমত নন। ইসলামের সম্পূর্ণ চরিত্র জানতে হলে এগুলোর সাথে কোরাণ-রসুলের অন্যান্য সংশিষ্ট সূত্রগুলো একসাথে করে দেখতে হবে। ওপরের প্রতিটি বিষয়ে এ-বইয়ের বিভিন্ন পরিচ্ছেদে সেই সব অন্যান্য সংশিষ্ট সূত্রগুলো বিস্তারিত দেয়া আছে যাতে পাঠক ইসলামের সঠিক ও সম্পূর্ণ চিত্র পান।

এ নিবন্ধে তিনি উলেখ করেননি, কোরাণ লঙ্ঘনের কারণে শারিয়া আইনে বিভিন্ন মুসলিম দেশে যেভাবে নারী-নির্যাতন হচ্ছে তার সমালোচনা করছেন বহু মুসলিমরাই। মুশকিল হল এ-সমালোচনা দেখলেই শারিয়া-সমর্থকেরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কাজেই এ-থেকে কিভাবে ইসলামি পদ্ধতিতেই বেরিয়ে আসা যায় সে আলোচনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। একদিকে তাঁরা স্বীকার করেন যে অন্যান্য কিছু ধর্মের মত ইসলামের নামেও কিছু নারী-নির্যাতন হয়েছে, অন্যদিকে সে নির্যাতন দেখানোর সাথে সাথে তাঁরা ইউরোপ- আমেরিকায় কিভাবে এবং কত নারী নির্যাতন হয় তার তালিকা নাকের ডগায় তুলে ধরেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠা করার প্রাণান্ত চেষ্টা করেন যে ‘ওদের চেয়ে আমরা ভাল আছি !’ ভাবখানা এই যে, পরীক্ষায় আমরা একশোতে দশ পেলে কি হবে ওরা তো পেয়েছে সাত, কাজেই আমরা ওদের চেয়ে ভাল আছি। শারিয়াপন্থী খবরের কাগজগুলোতে এটা খু-ব-ই দেখা যায়। এটা আসলে নিজেকেই ঠকানো কারণ দু’জনেই ডাব্বা মারা ফেল্। এই ফাঁকা আত্মতৃপ্তিতে নিশ্চিন্ত থাকলে একটা মস্তবড় ক্ষতি হয়। তা হল, পশ্চিমা দেশে যা হচ্ছে তা ওরা দেখুক, আমাদের মা-বোনেরা কিভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন এবং কিভাবে আমরা তা বন্ধ করতে পারি সেদিক থেকে আমাদের মনযোগ সরে যায়।

এটা খুবই সত্যি যে পশ্চিমা দেশেও নারী নির্যাতন হয় এবং অনেকই হয়। কিন্তু পশ্চিমা দেশে নারী-নির্যাতনের যে তালিকা তাঁরা দেখান তা কিন্তু ঐ পশ্চিমা দেশেরই সরকার বা কোন সংগঠনের পরিশ্রমের ফসল। ওখানে ওরা নিয়ত গবেষণা করে চলেছে দেশে ও বিদেশে নারী-নির্যাতন কোথায় বাড়ছে, কি কারণে বাড়ছে, এবং কোথায় কমছে, কি কারণে কমছে। এ-সব তথ্য থেকে ওরা বের করার চেষ্টা করে কিভাবে কি করলে নারী-নির্যাতন বন্ধ হতে পারে, এবং সরকারও এ-সব গবেষণার ভিত্তিতে আইন তৈরি করে। আমাদের দেশেও এমন গবেষণা কিছু হচ্ছে যদিও আরো হওয়া দরকার। কিছু ব্যতিক্রম বাদে আমাদের সরকারগুলো সাধারণত এ-সব গবেষণাকে পাত্তা দেয় না। আরব দেশগুলোতে তো নারী-নির্যাতনের ওপরে কার্যকর কোন গবেষণাই নেই। পশ্চিমা দেশে রাষ্ট্রীয় আইন বা ধর্মীয় নেতৃত্ব নারী-নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবেই দেখে, ওটাকে বৈধ করার চেষ্টা করে না। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোতে কিছু বিশেষ নারী-নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে দেখা তো হয়ই না, বরং আল্লার আইনের নামে বৈধ করা হয়। তাছাড়া, মুখে ‘আল্লাহই সবচাইতে ভাল জানেন’ (যার একমাত্রই অর্থ হল ‘আমি যা জানি তা অসম্পূর্ণ কিংবা ভুল হতে পারে’) বলার পর রাষ্ট্র আইন বানিয়ে জাতির ওপর নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়াটা ইসলামের নিদারুণ বরখেলাপ কিনা সেটা বুঝে নেয়ার ভারও আমি পাঠকের ওপরেই ছেড়ে দিচ্ছি।

শারিয়াপন্থীরা এটাও বলেন না যে পশ্চিমা দেশে আইন প্রণয়নে নারীজাতির অবদান অসামান্য কিন্তু হাদিসে নারীজাতির কিছু অবদান থাকলেও শারিয়া আইনে কোনই অবদান নেই। চোদ্দশ’ বছরের মধ্যে একজনও নারী শারিয়া-ইমামের নাম পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, মুসলিম নারীর জীবনে শারিয়া আইনের প্রভাব নিয়ে গত চোদ্দশ’ বছরে কোন উলেখে যাগ্য গবেষণাই নেই। তৃতীয়ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, শারিয়াপন্থীরা কখনোই পশ্চিমা দেশের নারী-নির্যাতনের বাস্তবতার সাথে শারিয়া-রাষ্ট্রে নারী-নির্যাতনের বাস্তবতার তুলনা করেন না। তাঁরা ওদের বাস্তবতার সাথে নিজেদের তত্ত্বের তুলনা করেন। এটা অন্যায়, এবং খুব সূক্ষ্ম অন্যায়। ওদের তত্ত্বের সাথে শারিয়া-তত্ত্বের তুলনা করা দরকার, ওদের নারীনির্যাতনের তনের বাস্তবতার সাথে শারিয়া-রাষ্ট্রে নারী-নির্যাতনের বাস্তবতার তুলনা করা দরকার। তাহলেই দেখা যাবে ওদের দেশে নারী-নির্যাতন অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত বলে এবং এর ওপরে গবেষণা হচ্ছে বলে প্রতিকার করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু শারিয়া-রাষ্ট্রে নারীনির্যাতন ইসলামের নামে বৈধ বলে এবং গবেষণা তেমন হচ্ছে না বলে এর প্রতিকার অত্যন্ত কঠিন। ধর্মের নামে অত্যাচার হলে কয়েকটা ঘটনা ঘটে। প্রমত, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের মনে সেটা অত্যাচার হিসেবে ততটা উপলব্ধি হয় না। দ্বিতীয়ত, কেউ কেউ সেটা বুঝলেও প্রতিবাদ করতে ভয় পায় কারণ সেই প্রতিবাদ আবার খোদ ধর্মের বিরুদ্ধেই চলে যায় কিনা সে সংশয় ও ভয় থাকে। তাছাড়া, অত্যাচারীরা ধর্মের ধ্বজা ধরে থাকে বলে ধর্মের অঘোষিত মালিক বনে যায়, প্রতিবাদকারীর ওপরে নানারকম অত্যাচার করার ক্ষমতা রাখে। তৃতীয়ত, এজন্যই ধর্মের নামে যারা অত্যাচার করে তাদের শাস্তির আইন এখনো কার্যকরভাবে বানানো যায়নি। বরং ওরাই আইনের এবং শাস্তি দেবার মালিক বনে থাকে। তাই মানুষের ইতিহাসে ধর্মের নামে যারা অত্যাচার করে তাদের শাস্তির উদাহরণ খুবই কম। চতুর্ ত, ওদের শাস্তি হয় না বলে স্পর্ধা ও অত্যাচার আরো বেড়ে যায়। এটাই মানুষের ধর্মীয়-সামাজিক বিবর্তনের একটা বৈশিষ্ট্য।

শারিয়াপন্থীদের আর একটা মোক্ষম যুক্তি হল, ‘পৃথিবীর প্রথম লিখিত গঠনতন্ত্র’। তাঁদের দাবি, এই গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে নবীজী রাষ্ট্র-পরিচালনা করেছিলেন বলে এটা ইসলামি ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গই শুধু নয়, এর ভিত্তিতে বিশ্ব-শারিয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই হল বিশ্ব-মুসলিমের ওপরে আল্লাহ-রসুলের নির্দেশ। এ না করলে “আর কিভাবে আলাহেক সন্তুষ্ট করা যায় আমি জানি না” − মওলানা মওদুদি। এর ওপরে লেখক ডঃ হামিদুলাহর বিখ্যাত বই ‘দ্য ফার্স্ট রিট্ন্ কন্সটিটিউশন ইন্ দ্য ওয়ার্লড’। অর্থাৎ কিনা যাকে ‘পৃথিবীর প্রথম লিখিত গঠনতন্ত্র’ বলে দাবি করা হয়। দাবিটার ফাঁক ও ফাঁকি দেখানো হয়েছে “পৃথিবীর প্রথম লিখিত গঠনতন্ত্র” অধ্যায়ে ।

তাঁরা খেলাফত ফিরিয়ে আনতে চান। কিন্তু মুসলিম ইতিহাসের যে কোনো বই কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি ইতিহাসের যে কোনো ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে চোদ্দশ’ বছর ধরে বাস্তবে কি ঘটেছিল। মুসলিম খেলাফতে হাতে গোনা কয়েকজন জ্ঞানপিপাসু ন্যায়পরায়ণ খলিফা ছাড়া বাকি শতাব্দী ধরে জনগণের ওপরে মর্মান্তিক রক্তস্রোত বয়েছিল। ৬৬১ সালে হজরত আলী নিহত হবার পর থেকে মুসলমানের ইতিহাস ভারাক্রান্ত হয়ে আছে অসংখ্য গৃহযুদ্ধে, এর সাথে ইসলামের কোনো যোগ নেই শুধু নামের খোলস ছাড়া। আমরা শুধু যুদ্ধের কথাই পড়ি, কিন্তু খেয়াল করি না সেইসব কোটি-কোটি মৃতদেহ এবং সেই সাথে কোটি-কোটি আহতের আর্তনাদ, উজাড় বসতি ও বিধবা-এতিমের হাহাকার। ইতিহাসের প্রথম তিন শতাব্দী তুলে দিচ্ছি, এর পরের কাহিনীও একই রকম মর্মান্তিক।

সাল

৬৬১ − হজরত আলী নিহত − সিরিয়ার শাসক মাবিয়া উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা

৬৮০ − মাবিয়ার মৃত্যু, এজিদ খলিফা হল- কারবালায় নবীজীর প্রিয় নাতি হজরত হোসেন সহ ও-পরিবারের অনেকে নিহত

৬৮৪ − মক্কায় আবদুলা বিন জুবায়ের-এর খলিফা হবার ঘোষণা, র্মাজ রাহাত-এর যুদ্ধ

৬৮৭−৬৯২ − কুফা-য় মুখতার নিজেকে খলিফা ঘোষণা করলে মক্কায় জুবায়ের, কুফা-য় মুখতার ও সিরিয়ায় এজিদের বংশধর আবদুল মালিক, একসাথে এই তিন খেলাফতের উদ্ভব ও রক্তাক্ত যুদ্ধে মুখতার ও জুবায়ের নিহত। আবদুল মালিকের সেনাপতি হিসাবে ইতিহাসের কুখ্যাত নৃশংস হত্যকারী হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ক্রমাগত গণহত্যা। সাহাবী সহ লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে সে খুন করেছে

৬৯৫ − জাজিরা, আহয়াজ ও কারুন-এর তিনটে যুদ্ধ

৭০২ − ইরাকে আশাথ বিদ্রোহ, দায়রুল জামিরা’র যুদ্ধ

৭০২ থেকে ৭৩৭ পর্যন্ত মুসলিম সৈন্যদের বহু দেশ জয় ও ফ্রান্সের সীমানায় পরাজয় − আবার মুসলিমের গৃহযুদ্ধ শুরু

৭৪০ − (ক) ইরাবে শিয়া বিদ্রোহ। (খ) উত্তর আফ্রিকায় বারবার বিদ্রোহ

৭৪৩ − খোরাসানে শিয়া বিদ্রোহ

৭৪৪ − বিদ্রোহীদের অভ্যুত্থানে খলিফা ২য় ওয়ালিদ নিহত

৭৪৫ − খোরাসানে আবার শিয়া বিদ্রোহ − খারাজী দ্বারা কুয়া ও মসুল দখল

৭৪৬ − খোরাসানে আবু মুসলিমের বিদ্রোহ

৭৪৯ − ইস্পাহান ও নিহাওয়ান্দ-এর যুদ্ধ

৭৫০ − (ক) আব্বাসীয়-দের দ্বারা রক্তাক্ত গণহত্যায় উমাইয়া খেলাফতের অবসান। (খ) যাব-এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ

৭৫৫ − খোরাসানে আবার বিদ্রোহ

৭৬২ − ইব্রাহিম ও নাফ্উজ জাকিয়া-র নেতৃত্বে শিয়া বিদ্রোহ

৭৬৭ − সিজিলমাসা-য় খারেজী শাসনের শুরু

৭৭২ − উত্তর আফ্রিকায় জানবি-র যুদ্ধ, মরক্কোতে বিদ্রোহী রুস্তমিদ খেলাফত শুরু

৭৮৮ − মগরেব-এ ইদ্রিসিদ খেলাফত শুরু

৭৯৯ − খাজার-দের বিদ্রোহ দমন

৮০০ − উত্তর আফ্রিকায় আঘলাবিদ খেলাফত শুরু

৮০৩ − ইমাম জাফর বারমকি-র খুন

৮১৪ − খলিফা হারুন রশীদের মৃত্যুতে দুই পুত্র আল্ আমিন ও আল্ মামুনের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। আল্ আমিন নিহত

৮১৫ − ইবনে তুবা-র নেতৃত্বে শিয়া বিদ্রোহ − কয়েক বছর যুদ্ধের পর সেনাপতি হুরমুজান নিহত

৮২০ − খোরাসান-এ তাহিরিদ খেলাফত শুরু

৮২৭ − মুতাজিলা-দের সাথে অন্যান্যদের বিরোধ শুরু

৮৩৭ − জাট (ভারতের নয়) বিদ্রোহ

৮৩৮ − আজারবাইজান-এ বাবেক বিদ্রোহ দমন

৮৪৩ − তাবারিস্তান-এ মাজাইর বিদ্রোহ

৮৬১ − বিদ্রোহী অভ্যুত্থানে খলিফা মুতাওয়াক্কিল নিহত

৮৬৪ − তাবারিস্তান-এ যায়দি খেলাফত শুরু

৮৬৬ − খলিফা মুতাসিম বিতাড়িত − নূতন খলিফা মুতা’জ

৮৬৭ − সিস্তান-এ সাফারিদ খেলাফত শুরু

৮৬৮ − মিশরে তুলুনিদ খেলাফত শুরু

৮৬৯ − খলিফা মুতা’জ বিতাড়িত − নূতন খলিফা দাসী-পুত্র আল্ মুহতাদি

৮৭০ − তুর্কী বিদ্রোহে আল্ মুহতাদি নিহত − নূতন খলিফা আল্ মুতামিদ

৮৭৩ − রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তাহিরিদ খেলাফতের উচ্ছেদ

৮৭৪ − দক্ষিণ ইরাকে জাঞ্জ বিদ্রোহ

৮৯১ − কেন্দ্রীয় খেলাফত অস্বীকার করে বাহরায়েন-এ কামাতিয়ান শাসনে উদ্ভব

৮৯৭ − কামাতিয়ান দ্বারা বসরায় গণহত্যা

৯০৫ − মসুল ও জাজিরা-য় হামদানিদ খেলাফত শুরু − মিশরে তুলুনিদ খেলাফতের উচ্ছেদ

৯০৮ − সামানিদ খেলাফত দ্বারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সাফারিদ খেলাফতের অবসান অন্যান্য সূত্র ও ইসলামিক ওয়েরসাইট ঃ−
http://www.muslimaccess.com/sunnah/historyofislam/centuries/century9.html

বিভিন্ন দলিলে সালের কিছু পার্থক্য দেখা যায়।

মুসলমানের হাতে মুসলমানের চোদ্দশ’ বছরের গণহত্যা ১৯৭১ সালেও শেষ হয়নি ॥