মনে করুন বাজারে মাথাব্যথার একটা ওষুধ আছে যা বানাতে হাজারো বৈজ্ঞানিকের লক্ষ পৃষ্ঠার সুবিশাল গবেষণা লেগেছে। কিন্তু ওটা খেলে মাথাব্যথা তো সারেই না, বরং পেট খারাপ হয়ে যায়। এমন ওষুধকে কি করে মানুষ ? নীচে দেখুন কিছু শারিয়া আইনও হুবহু তাই । অথচ শিশুকাল থেকে ‘আলার আইন’ লেবেল দেখতে দেখতে বড় হবার ফলে ওই অন্যায় অত্যাচার অনেকের চোখে পড়ে না। ক্ষমতার ষড়যন্ত্র আর পুরুষতন্ত্র কিছু মুসলমানের বুঝবার ক্ষমতাকে বিভিনড়ব ব্যাখ্যা দিয়ে অবশ করে দিয়েছে। কিন্তু এত স্পষ্ট অন্যায় আইন বুঝতে আমাদের কোরাণ-হাদিস পড়তে হবে কেন ? আমাদের বিবেক নেই ? বুদ্ধি নেই ?
প্রমেই প্রাচীন ভারতের কিছু প্রাচীন আইন দেখা যাক। পুরুষতন্ত্রের সর্বগ্রাসী লালসার পাশাপাশি নারী-নিয়ন্ত্রণের আরেকটা প্রধান কারণ হল ঃ “Mother’s
Baby, Father’s May be” অর্থাৎ নিজের বাচ্চাদের পিতৃত্ব নিশ্চিত করা। আমি এ আইনগুলো দেখাচ্ছি শারিয়ার সাথে তুলনা করার জন্য নয়, বরং এটা দেখাতে, আমাদের অনেকে যেমন শারিয়াকে আলাহ’র আইন মনে করেন সেরকম ওরাও ওই আইনগুলোকে ‘ভগবানের আইন’ বলে বিশ্বাস করত। বিখ্যাত চিত্রপরিচালক দীপা মেহ্তা তাঁর সাম্প্রতিক ছবি ‘ওয়াটার’-এ দেখিয়েছেন ভারতে এখনও প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ বিধবা নিজের ইচ্ছায় পশুর চেয়েও অধম জীবনযাপন করে দু’হাজার বছর আগে বানানো মনু’র আইনকে ‘ভগবানের আইন’ মনে করে। অথচ মনু একজন মানুষই ছিল। শুধু তাই নয়, কেউ এসব আইন সংস্কার করতে বললে তারাও শারিয়াপন্থীদের মতই তেড়ে মারতে আসে। দেখুন, ধর্মের নামে এসব আইনেও নারীর প্রতি পুরুষের একই বিষাক্ত মনোভাব কাজ করছে।
- বিধবাকে মৃত স্বামীর সাথে পুড়িয়ে মারার আইন ঃ “জীবিত নারীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মৃতের বধূ হতে…এই নারী পতিলোকে যাচ্ছে, এ-প্রাচীন রীতি অনুসরণ করছে” (অথর্ববেদ ১৮/৩/৩)।
- “পিতামাতার জন্য কন্যা অভিশাপ” (ঐত্তরীয় ব্রাহ্মণ ৬/৩/১৩)।
- “লাঠি দিয়ে স্ত্রীকে মেরে দুর্বল করা উচিত যাতে শরীরের ওপরে তার কোন অধিকার না থাকে” (শতপথ ব্রাহ্মণ ৪/৪/২/১৩)।
- সর্বগুণান্বিতা নারীও অধমতম পুরুষের চেয়ে অধম” (তৈত্তরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২)।
- গৃহকর্মে ও দায়িত্বে স্ত্রীর অসামান্য অবদানের পরেও ‘ভার্য্যা’ (স্ত্রী) ও ‘ভৃত্য’ শব্দ দু’টোর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ একই − যাকে ‘ভরণ’ অর্থাৎ ভরণপোষণ করতে হয় দু’টোরই উৎস ‘ভৃ’ ধাতু)।
- “পুত্র-কন্যার সামনে স্বামী উপপতড়বী আনা বা বেশ্যাগমন করতে পারবে কিন্তু স্ত্রীর সামান্য পদস্খলনে সমাজ কঠোর দণ্ড দেবে” (মৈত্রায়নী-র বিভিনড়ব আইন ও তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২)।
- “কালো পাখি, শকুন, নেউল, ছুঁচো, কুকুর ও নারী হত্যার প্রায়শ্চিত্ত একই” (আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র ১/৯/২৩/৪৫)।
- “নারীকে অবরুদ্ধ রাখো, নাহলে তার শক্তিক্ষয় হবে” (শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪/১/১/৩১)।
- একটি যজ্ঞে “সদ্যোজাত পুত্রকে ওপরে তুলে ধরা হয়, কন্যাকে মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়” (তৈত্তরীয় সংহিতা ৬/৫/১০/৩)।
- “উত্তম নারী হল ‘যে স্বামীকে সন্তুষ্ট করে, পুত্র-সন্তানের জন্ম দেয় ও স্বামীর কথার ওপরে কথা বলে না’” (ঐত্তরীয় ব্রাহ্মণ ৩/২৪/২৭)।
- “সন্তান না জন্মালে ১০ বছর পর ও পুত্র না জন্মালে ১২ বছর পর স্ত্রীকে ত্যাগ করা যাবে” (আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র ১/১০-৫১-৫৩)।
- “যার স্ত্রীর চেয়ে পশুর সংখ্যা বেশি সে সৌভাগ্যবান” (শতপথ ব্রাহ্মণ ২/৩/২/৮)।
ইত্যাদি শত শত। (সূত্র ঃ প্রাচীন ভারত − সমাজ ও সাহিত্য − ডঃ সুকুমারী ভট্টচার্য্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক − কম্পেয়ারেটিভ লিটারেচার অ্যাণ্ড কালচার)। একই রকম প্রচণ্ড নারী-বিরোধীতা ছিল স্রষ্টার নামে বানানো ইহুদী − খ্রীষ্টান আইনেও, তার কিছুটা ধরা আছে বাইবেলের ডিউটেরনমি অধ্যায়ে।
যে শারিয়ার জন্য এত হৈ হৈ, যার পেছনে এত প্রতিষ্ঠান এত কর্মী এত অর্থ, যার জন্য বাংলাদেশে শারিয়া-জঙ্গীরা বোমাবাজি করে এত নিরীহ মানুষ খুন করল, এত বিধবা হল, এত এতিম হল সেই শারিয়া আইনগুলো আসলে কি তা কেউ দেখান না। কিন্তু আইনগুলো যদি জাতি না-ই জানে তবে এর ওপরে সিদ্ধান্ত নেবে কি করে ? তাই এবারে চলুন তাহলে ইসলামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কিছু শারিয়া কেতাব থেকে কিছু শারিয়া- আইন দেখি। কাউকে কিছুই বলতে হবে না, আইনগুলো নিজেরাই আমাদের বলে দেবে আসলেই তারা কি। তাই খুব সতর্কভাবে কটা জিনিস খেয়াল রাখবেন।
(১) কোরাণ-হাদিসে মানবাধিকার ও নারী-অধিকারের ওপরে অত্যন্ত সুন্দর বহু উপদেশ আছে কেউ সে উপদেশ না মানলে আদালতে শাস্তি হয় না। কিন্তু নারী-বিরোধী আইন না মানলে শাস্তি হয়। আপনারা জানেন স্বার্থের সঙ্ঘাতে আইনের কাছে উপদেশ পরাজিত হতে বাধ্য। কাজেই শারিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীর মৃত্যুফাঁদ।
(২) যেগুলোতে আইন নম্বর দেয়া আছে সেগুলো প্রয়োগের জন্য তৈরি। নাহলে নম্বর দেয়া থাকত না। কিছু আইনের ব্যাখ্যায় বলা আছে − “এ আইন পরিবর্তনের সুযোগ আছে।” কিন্তু চোদ্দশ’ বছরে পরিবর্তন না হয়ে আইনগুলো প্রয়োগ হয়েই চলেছে অনেক দেশে। পরিকল্পনা করেই এটা করা হয়, ভুল করে নয়।
(৩) আইনগুলোর বহু জায়গায় বলা আছে − ‘যাহা স্থির করা হইয়াছে’ কিংবা ‘যে অধিকার দেয়া হইয়াছে’ কিংবা ‘যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হইয়াছে’ ইত্যাদি। সিদ্ধান্তটা কে নিল, অধিকারটা কে দিল বা স্থিরটা কে করল তা খেয়াল করলেই দেখা যাবে এগুলো করেছেন কিছু মানুষ। তাঁরা দিব্যজ্ঞানী নবী-রসুল তো নন। কাজেই তাঁদের কথা মানা বা না-মানা সম্পূর্ণ আমাদের বিশেষজ্ঞদের অধিকার।
(৪) কিন্তু শারিয়া আইনে বলা হয়েছে অতিতের ঐ-সব সিদ্ধান্ত কেউ না মানলে সে মুরতাদ, অর্থাৎ তার মৃত্যুদণ্ড হবে। এভাবে নিজেদের বর্তমান বিশেষজ্ঞদেরকে ব্যা কমেল করে পঙ্গু করে বিশ্ব-মুসলিম আজ কোথায় পৌঁছেছে তা সবাই জানেন।
নীচের উদাহরণগুলো প্রায় সবই আমাদের কাছে আছে, কেউ কোন পৃষ্ঠার ফটোকপি দেখতে চাইলে ফ্যাক্স নম্বর পাঠিয়ে দেবেন, আমরা ফ্যাক্স করে পৃষ্ঠাটা দুনিয়ার যে কোনো জায়গায় পাঠিয়ে দেব। এ-বইয়ে বি-ই-আ হল বাংলাদেশ ইসলামি ফাউণ্ডেশন কর্তৃক বাংলায় প্রকাশিত বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন। আর ‘বাংলা কোরাণ’ বলতে বুঝানো হয়েছে মওলানা মুহিউদ্দিনের করা কোরাণের বাংলা অনুবাদ। ওটা আসলে ভারতের দেওবন্দী মুফতি শফি’র করা কোরাণের রাজনৈতিক অনুবাদ। ওটা সৌদি বাদশার সিংহাসন রক্ষা করে বলে সৌদি “কোরাণ প্রিণ্টিং প্রেস” থেকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ ক’রে বিশ্বময় বিনামূল্যে কোটি কোটি কপি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বইটার ২য় পৃষ্ঠায় স্পষ্ট লেখা আছে ঃ “পবিত্র কোরাণের এ তরজমা খাদেমুল হারমাইনিশ্-শরীফাইন বাদশাহ্ ফাহদ ইবনে আবদুল আজীজের পক্ষ থেকে ওয়াক্ফ্লিলাহ হাদিয়া স্বরূপ প্রদত্ত, বিক্রয় নিষিদ্ধ।” কিন্তু বাজারে ওটা মুফত তো পাওয়া যাবেই না, হাজার হাজার কপি বিক্রি হচ্ছে। এই হলো শারিয়াপন্থীদের চরিত্র। বলে দেয়া দরকার, সূত্র বিশেষে কিছু আইনের পার্থক্য দেখা যায়।
বি-ই-আ ১ম খণ্ড ও অন্যান্য সূত্র থেকে ঃ
- খাবার, বাসস্থান ও পোশাক দিতে স্বামী বাধ্য থাকবে শুধুমাত্র বাধ্য স্ত্রীকে, অবাধ্য স্ত্রীকে নয়। এর বাইরের সব খরচ এমনকি ডাক্তারের, ওষুধের বা সৌন্দর্য্য-চর্চার খরচ ইত্যাদি হবে স্বামীর করুণা ও দয়া। (বলাই বাহুল্য, স্ত্রী অবাধ্য কি না সেটা ঠিক করবে স্বামী নিজেই)। হানাফি আইন পৃঃ ১৪০ ; শাফি’ই আইন পৃঃ ৫৪৪ − Law #m.11.4 ; মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত বাংলা কোরাণ পৃঃ ৮৬৭ − তফসীর ঃ “স্ত্রীর যে প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করা স্বামীর যিম্মায় ওয়াজিব (বাধ্য), তা চারটি বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ − আহার, পানীয়, বস্ত্র ও বাসস্থান। স্বামী এর বেশি কিছু স্ত্রীকে দিলে অথবা ব্যয় করলে তা হবে অনুগ্রহ, অপরিহার্য নয়।”
- “(স্বামীর) বৌ-তালাকে সাক্ষ্য শর্ত নহে” (বি-ই-আ ১ম খণ্ড, ধারা ৩৪৪)। এবারে খুলুন কোরাণ, সুরা ত্বালাক, আয়াত ২ − “তোমরা যখন স্ত্রীদিগকে তালাক দিতে চাও তখন দুইজন সাক্ষী রাখিবে।”
- শারিয়ায় চুরি, ডাকাতি, পরকীয়া, মদ্যপান, রাষ্ট্রদ্রোহিতা ইত্যাদির শাস্তি হল হাত-পা কাটা, জনসমক্ষে চাবুকের আঘাত, জনসমক্ষে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড, ইত্যাদি। কিন্তু ওই শারিয়া আইনেই আছে “রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে হুদুদ মামলা করা যাবে না” (বি-ই-আ ৩য় খণ্ড নং ৯১৪গ এবং হানাফি আইন পৃঃ ১৮৮)।
- বি-ই-আ ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩০১ ঃ “যদি রাষ্ট্রপ্রধান বা তাঁর প্রতিনিধি কাউকে বাধ্য করে কোন নারীকে ধর্ষণ করতে, তবে ধর্ষণকারী শাস্তি পাবে না।”এ-আইনে “রাষ্ট্রপ্রধান বা তাঁর প্রতিনিধি”র কোন শাস্তির উলেখ নেই। কেউ বলতে পারেন, অন্যত্র শাস্তির কথা আছে। কিন্তু এখানেও সেটা নেই বলে কোন বাকপটু দুর্ধর্ষ উকিল তার অপরাধী মক্কেলকে খালাস করে নেবেই, কেউ ঠেকাতে পারবে না।
- বি-ই-আ ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩১১, ধারা ১৪৯ ঃ “বোবা’র সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।” কিন্তু বোবা’র তো চোখ আছে, সে তো দেখতে পারে। তার সাক্ষ্য ছাড়া চোর-ডাকাতখুনীরা পার পেয়ে যাবেই কখনো কখনো। এটা আলাহ’র আইন হতে পারে না।
- দাস-দাসী, গায়িকা এবং সমাজের নীচু ব্যক্তির (উদ্ধৃতি ঃ রাস্তা পরিষ্কারকারী বা শৌচাগারের প্রহরী, ইত্যাদি) সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। হানাফি আইন পৃঃ ৩৬১ ; শাফি’ই আইন পৃঃ ৬৩৬ − Law #o.24.3.3 ; পেনাল ল’ অব্ ইসলাম পৃঃ ৪৬ ; বিধিবন্ধ ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৬৩)। কিন্তু ওদেরও তো চোখ-কান-বিবেক আছে। ওরা তো চুরি-ডাকাতি দেখতে পারে ঠিক আমার-আপনার মতই। ওদের সাক্ষ্য ছাড়া চোর- ডাকাত-খুনীরা পার পেয়ে যাবেই কখনো কখনো। এটা আলাহ’র আইন হতে পারে না। তাছাড়া, আইনটায় গায়কের কোন কথা নেই, এটাও তো অন্যায় হয়ে গেল।
- হুদুদ মামলায়, বিশেষত ব্যভিচারে ও খুনের মামলায়, নারী-সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। (হানাফি আইন পৃঃ ৩৫৩ ; শাফি’ই আইন পৃঃ ৬৩৮ − Law #o.24.9। ক্রিমিন্যাল ল’ ইন্ ইসলাম অ্যাণ্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্লড পৃঃ ২৫১। মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত বাংলা কোরাণ পৃঃ ২৩৯। পেনাল ল’ অব্ ইসলাম পৃঃ ৪৪ ; বিধিবদ্ধ ১ম খণ্ড, ধারা ১৩৩ ও ২য় খণ্ড, ধারা ৫৭৬)।
- নারীদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নহে, তাহাদের (১) স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা, (২) পরিচালন- ক্ষমতার দুর্বলতা ও (৩) বুঝিবার অক্ষমতার জন্য। (পেনাল ল’ অব্ ইসলাম পৃঃ ৪৫)।
- স্বামীর তরফ থেকে দেন-মোহর হতে পারে কোরাণ থেকে কিছু তেলাওয়াত বা লোহার আংটি বা একজোড়া জুতো। (শারিয়া দি ইসলামিক ল’ পৃঃ ১৬৩, ১৬৪ ; বিধিবদ্ধ ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৯৭৬ ; সহি হাদিস তিরমিজি, হাদিস নং ৯৫১)।
- বাবা-মা, দাদা-দাদি, বা নানা-নানিকে খুন করলে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে। কিন্তু বাবা মা, দাদা-দাদি বা নানা-নানি যদি ছেলে-মেয়ে বা নাতি-নাতনিকে খুন করে তবে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে না। (বি-ই-আ ১ম খণ্ড, ধারা ৬৫ ক ও খ ; শাফি’ই আইন পৃঃ ৫৮৪ − Law #o.1.2.4 এবং সহি তিরমিজি হাদিস ৯৯৪ ও ৯৯৫)।
- বি-ই-আ ১ম খণ্ড পৃঃ ৭৯, ধারা ১৫৬ ও ১৫৭ ঃ আত্মীয়ের বাসা থেকে চুরি করলে বা মেজবানের বাসা থেকে মেহমান চুরি করলে তার হুদুদ শাস্তি হবে না।
- তওবা করলে গণহত্যাকারীর শাস্তি হবে না। (বিধিবদ্ধ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১৮, ধারা ১৩)। ক্স বি-ই-আ ১ম খণ্ড পৃঃ ১৯৫, ধারা ৫১৪ ঃ মুতওয়ালী যদি ওয়াক্ফ্ সম্পত্তি হজম করে ফেলে তবে তার কাছ থেকে এ-সম্পত্তি আদায় করতে হবে, কোন শাস্তির উলেখ নেই।
- স্ত্রী যদি বলে তার মাসিক হয়েছে আর স্বামী যদি তা বিশ্বাস না করে, তাহলে স্ত্রীর সাথে সহবাস করা স্বামীর জন্য আইনতঃ সিদ্ধ (শাফি’ই আইন নং ই-১৩-৫)।
- “কোনো কারণে ধর্ষকের শাস্তি মওকুফ হইলে ধর্ষক ধর্ষিতাকে মোহরের সমান টাকা দিবে” (বি-ই-আ ১ম খণ্ড পৃঃ ৩০১ ; শাফি’ই আইন #m.8.10)। যেহেতু এখানে অন্য কোনো শাস্তির উলেখ নেই তাই ধর্ষক-পক্ষের চালাক বাকপটু উকিল ধর্ষককে টাকা দিয়ে খালাস করে নিতে পারবে। ধর্ষিতার শাস্তির বহু দলিল আমাদের কাছে আছে। ইসলামের নামে এই নির্মম নিষ্ঠুরতার ব্যাপারে কোন ইসলামি দল কোনদিন টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেননি।
- মুসলিম পুরুষের রক্তমূল্য অপেক্ষা, (১) মুসলিম নারীর রক্তমূল্য অর্ধেক, (২) ইহুদী- খ্রীষ্টানের রক্তমূল্য তিনভাগের একভাগ, ও (৩) অগিড়ব-উপাসকের (সম্ভবতঃ হিন্দুদেরও − লেখক) রক্তমূল্য পনেরো ভাগের একভাগ। (শাফি’ই আইন পৃঃ ৫৯০, Law #o.4.9)।
- রক্তমূল্যের দাবি বা খুনীকে মাফ করতে শুধু নিহতের পুত্ররাই পারে, কন্যারা নয়। (শারিয়া দি ইসলামিক ল’, ডঃ আবদুর রহমান ডোই, পৃঃ ২৩৫)।
- বিবাহিতা যুদ্ধ-বন্দিনীদের বিয়ে তৎক্ষণাৎ বাতিল হয়ে যাবে (শাফি’ই আইন #o.9.13 )। এ-আইনের উদ্দেশ্য অতি পরিষ্কার। সেটা হল যুদ্ধ-বন্দিনীদের ধর্ষণ। সেটাকে সহি হাদিসে বৈধ করা হয়েছে (সহি বুখারি ৫ম খণ্ড হাদিস নং ৬৩৭, ও ৭ম খণ্ড হাদিস নং ১৩৭)। এমনকি কেউ কেউ বন্দিনীদেরকে তাদের বন্দী স্বামীদের সামনেই ধর্ষণ করত এবং “কেহ কেহ তাহা পছন্দ করিত না” − সহি আবু দাউদ হাদিস নং ২১০৫। স্পষ্টই বোঝা যায় নবীজীর অনেক পরে এ-সব ভয়ঙ্কর হাদিস বানানো হয়েছে বন্দিনী-ধর্ষণ হালাল করার জন্য। আমাদের ‘আহলে হাদিস’ ইত্যাদি সংগঠনগুলোর উচিত অনতিবিলম্বে এ-সব হাদিস বাতিল করা। এ-সব হাদিসের ভিত্তিতেই আমাদের ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শর্ষিণার পীর ঘোষণা করেছিল পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের জন্য বাঙালী হিন্দু-নারী ধর্ষণ করা বৈধ। এটা সবাই জানে, দৈনিক পূর্বদেশ-এও ছাপা হয়েছিল একাত্তরের ১৯শে ডিসেম্বর তারিখে। অনেকে তাকে দোষ দিয়েছিলেন কিন্তু সে তো শুধু শারিয়া আইনের কথাই বলেছিল।
- বি-ই-আ ১ম খণ্ড পৃঃ ২১০, ধারা ২ − রোজার সময় কেউ কিছু খেলে, এমনকি গোপনে খেলেও, তার শাস্তি হবে। ১১ই নভেম্বর ২০০৫ বৃহস্পতিবারে ইরাণের সানান্দাদজ শহরের এক ১৪ বছরের বাচ্চা ছেলে রোজা রেখেছিল। বেচারা সামলাতে পারেনি, দুপুরে কিছু খেয়ে রোজা ভেঙে ফেলেছিল। শারিয়া আদালত তাকে ৮৫ চাবুক মেরে মেরেই ফেলেছে। অনিন্দ্যসুন্দর ফুলের মত সদ্য ফুটেছিল যে, যার সামনে ছিল বিস্তীর্ণ জীবন, সে মাটির নীচে পোকামাকড়ের খাদ্য হয়েছে। এ-রকম শত শত ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে ইরানের শারিয়া রাষ্ট্রে।
ইণ্ডিপেণ্ডেণ্ট-অন্-লাইন নভেম্বর ১৪, ২০০৬-এর খবরে প্রকাশ ঃ সোমালিয়ার নূতন শারিয়া সরকার সিগারেট পান করার ‘অপরাধে’ ২২ জনকে জনসমক্ষে (আমাদের গুলিস্তানের স্টেডিয়ামের মত জায়গায়) বেত্রাঘাত করেছে। আমার সোমালি বন্ধু জানিয়েছে, এর মধ্যে অনেক সম্মানিত মানুষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপকও ছিলেন। এর আগে এই শারিয়া-সরকার টেলিভেশনে বিশ্ব-ফুটবল খেলা প্রচার বন্ধ করে দেয় ও প্রতিবাদকারী তরুণদের মধ্যে একজনকে গুলি করে হত্যা করে।
- বি-ই-আ ১ম খণ্ড পৃঃ ১৩৬, ধারা ২৬৬ গ ও ২৭২ − বিয়ের সাক্ষী হতে হবে ২জন পুরুষ বা ১জন পুরুষ ও ২জন নারী, নাহলে বিয়ে অবৈধ হবে।
- মদ্যপানের সাক্ষী হতে হবে শুধুমাত্র দু’জন পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষ্য। মেয়েদের বা পুরুষ-মেয়েদের মিলিত সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় (বি-ই-আ ১ম খণ্ড পৃঃ ৩৩৩, ধারা ১৭৪)।
- স্বামী তার স্ত্রীকে যখন ইচ্ছে তখনই তাৎক্ষণিকভাবে পুরো তালাক দিতে পারবে। কোনো কোনো কেতাবে আছে অত্যাচারের চাপে, নেশার ঘোরে বা হাসি-ঠাট্টাতে ‘তালাক’ উচ্চারণ করলেও পুরো তালাক হয়ে যাবে (হানাফি আইন ৮১ ও ৫২৩ ; শাফি’ই আইন পৃঃ ৫৬০, Law #n.3.5 ; বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড পৃঃ ১৫৭ ধারা ৩৫১, পৃঃ ১৫৬ ধারা ৩৪৭, পৃঃ ১৫৭ ধারা ৩৪৯ ; পৃথিবীর বৃহত্তম ইণ্টারনেট সংগঠন ইউরোপিয়ান ফতোয়া কাউন্সিল, ইউনাইটেড মুসলিম্স্ ক্যানাডা সংগঠনের রায় ; ওয়েবসাইট www.sunnipath.com ইত্যাদি ; দ্বীন কি বাঁতে − মওলানা আশরাফ থানভি, পৃঃ ২৫৪, আইন নং ১৫৩৭, ১৫৩৮, ১৫৪৬ ও ২৫৫৫)। এ-নিয়ে অন্যত্র আলোচনা করা হয়েছে। এটা অন্যায় আইন। চাপের মুখে তালাকের আইনটাও সুরা নাহ্ল্ আয়াত ১০৬-এর মর্মবাণীকে লঙ্ঘন করে। এ-আয়াত অনুযায়ী তালাক তো দূরের কথা, কেউ কাউকে ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করলেও সেটা নাকচ হবে যদি মনে মনে নিয়ত ঠিক থাকে।
- “যে কোন কর্মের বাস্তব সঙ্ঘটনই উহাকে অপরাধকর্মে পরিণত করে। বাস্তবে সঙ্ঘটিত না হওয়া পর্যন্ত কোন কর্মের জন্য কাহাকেও দায়ী করা যায় না।” এর সাথে যোগ করুন ৩য় খণ্ডের ধারা ১২৮২ − “কোন ব্যক্তির অপরাধ প্রকাশ্য আদালতে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাহাকে গ্রেপ্তার বা আটকের মাধ্যমে তাহার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাইবে না।” এ ভয়াবহ আইনগুলো চালু হলে অপরাধীরা উৎসাহিত হবার সম্ভাবনা − সমাজে মারাত্মক খারাপ প্রভাব পড়বে। কারণ অনেক সময়ই নিজস্ব গুপ্তচরের সাহায্যে পুলিশ চুরি-ডাকাতি থেকে শুরু করো বোমাবাজী-খুন-গণহত্যা এমনকি পেন- হাইজ্যাকের পরিকল্পনা আগে থেকেই জেনে ফেলে ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে। এতে জনগণের জানমালের সুরক্ষা হয়, এবং অপরাধীরা ভয় পায়। এ-আইন হলে অপরাধীদের পোয়াবারো।
বি-ই-আ ২য় খণ্ড ও অন্যান্য সূত্র থেকে ঃ
- পৃঃ ২১৭, ধারা ৫৫৪ ঃ হুদুদ মামলায় নারী-বিচারক অবৈধ।
- পৃঃ ২৬৪, ধারা ৫৭৫ খ ঃ হুদুদ মামলায় সাক্ষ্য গোপন করা যেতে পারে। এ-আইন কোরাণের সম্পূর্ণ খেলাফ কারণ কোরাণ বলছে “তোমরা সাক্ষ্য গোপন কর না” (বাকারা ২৮৩), “কেন তোমরা … সত্য গোপন করছ” − ইত্যাদি, অনেক আয়াত।
- বিবাহ-বিচ্ছেদের পরে বাচ্চাদের অভিভাবকত্ব মা পাবে ছেলের ৭ ও মেয়ের ৯ বছর বয়স পর্যন্ত (এ-বয়স পর্যন্তই হাড়ভাঙা পরিশ্রমে বাচ্চাদের যতড়ব নিতে হয়)। এর পরে তারা বাবার কাছে চলে যাবে। কিন্তু মা যদি নামাজ না পড়ে এবং মাহরাম পুরুষের বাইরে কাউকে বিয়ে করে তবে বাচ্চারা বাবার কাছে চলে যাবে। স্বামীর নামাজ বা বিয়ে এ-ক্ষেত্রে ধর্তব্য নয় (হানাফি আইন ১৩৮ − ১৩৯ পৃঃ; শাফি’ই আইন পৃঃ ৫৫০, Law #m.13.0 ; বি-ই-আ ১ম খণ্ড, ধারা ৩৯৮)।
- তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী বাচ্চাদের পিতার অনুমতি ছাড়া বাচ্চাদের কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না (বি-ই-আ ১ম খণ্ড, ধারা ৪০৫ ; এবং ইরাণী শারিয়া)। –এক মারাত্মক আইন। এ-আইন তালাকের পরেও স্ত্রীর পায়ে লোহার শেকল পরিয়ে রাখে। বিশেষ করে যে-সব স্ত্রী বিদেশে ইমিগ্রেশন পেয়েছেন তাঁরা স্বামীর ইচ্ছের সামনে অসহায় হয়ে পড়েন। ক্যানাডায় শত শত ইরাণী ইমিগ্র্যাণ্ট মায়েদের দুর্দশা দেখলে এ-আইনের নৃশংসতা বোঝা যায়।
- বিয়েতে মেয়েরা অভিভাবক হতে পারবে না (হানাফি আইন ১৩৮ − ১৩৯ পৃঃ ; শাফি’ই আইন Law #m.3.4.1 – p 518)।
- তাৎক্ষণিক তালাকের পর মুহূর্ত থেকে স্ত্রী খাবার বাসস্থান কিছুই পাবে না। সাধারণ তালাকের পর স্ত্রী মাত্র তিন মাসের জন্য খোরপোষ পাবে। তারপর তারা কোথায় যাবে কি খাবে তার উলেখ নেই (হানাফি আইন পৃঃ ১৪৫ ; শাফি’ই আইন Law #m.11.10, 1 and 3 – p 546)। ক্স “কোনো অমুসলমানকে খুন করার অপরাধে কোন মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড হবে না” (পেনাল ল’ অফ ইসলাম পৃঃ ১৪৯)।
বি-ই-আ ১ম খণ্ড থেকে ঃ
- শারিয়া অনাথ শিশুকে দত্তক নেবার প্রা অনুমোদন করে না (সব শারিয়া বই ; শারিয়া দি ইসলামিক ল’ − ডঃ আবদুর রাহমান ডোই, পৃঃ ৪৬৩)। ক্স হুদুদ মামলায় পারিপার্শ্বিক প্রমাণ চলিবে না − (চাক্ষুষ সাক্ষী থাকতে হবে) (বি-ই-আ ২য় খণ্ড ধারা ৬০০)। এতে মুশকিল হল, চুরি-ডাকাতি-খুনের চাক্ষুষ প্রমাণ প্রায়ই পাওয়া যায় না, পারিপার্শ্বিক প্রমাণেই অপরাধীর শাস্তি হয়। এআইন হলে বহু অপরাধীরই শাস্তি হবে না।
- শর্ত-সাপেক্ষে অবাধ্য স্ত্রীকে পেটানো অনুমোদিত (সব শারিয়া কেতাব ; শাফি’ই আইন m.10.12, o.17.4 এবং বহু বহু সূত্র)।
- ইমাম শাফি’ই থেকে, সূত্র ৮, পৃঃ ৫২৫, আইন নং এম-৫-১ ঃ “স্বামীর যৌন- আহ্বানে স্ত্রীকে অনতিবিলম্বে সাড়া দিতে হবে যখনই সে ডাকবে, যদি শারীরিকভাবে সে স্ত্রী সক্ষম হয়। স্বামীর আহ্বানকে স্ত্রী তিনদিনের বেশি দেরি করাতে পারবে না।”
- ইমাম শাফি’ই থেকে, সূত্র ৮, পৃঃ ৫৩৮, আইন নং এম-১০-৪ ঃ “নবী (দঃ) বলেছেন, আলাহ এবং কেয়ামতে যে স্ত্রী বিশ্বাস করে, সে স্বামীর অনিচ্ছায় কাউকে বাসায় ঢুকতে দিতে বা বাসার বাইরে যেতে পারবে না।”
বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন বলছে ঃ “বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ট্রাক ও বাস অ্যাক্সিডেণ্টে নিরীহ মানুষ মরিতেছে। তাহাদের সন্তানসন্ততির করুণ দশার পূর্ণ ও যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণের দিকে পাশ্চাত্য আইন কোন দৃষ্টি দিবার পর্যাপ্ত বিধান রাখে নাই। এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিপূরণের বিধান ইসলামি আইনের সর্বকালীন আধুনিকতা প্রমাণ করে” (১ম খণ্ড, পৃঃ ১০)। কথাটা ডাঁহা মিথ্যা। পাশ্চাত্য আইনে নিহতের পরিবারকে যথেষ্ট (ক্যানাডায় দশ লক্ষ ডলার পর্য্যন্ত) ক্ষতিপূরণ-বীমার ব্যবস্থা আছে। পরিমাণটা সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট, কমবেশি করার উপায় নেই। এ বীমা ছাড়া গাড়ি চালালে এমন হিংস্র আইন প্রয়োগ করা হয় যে খুব কম লোকই বীমা-ছাড়া গাড়ি চালাতে সাহস করে।
বি-ই-আ ৩য় খণ্ডে আর গেলাম না। এ-রকম শত শত আইন আছে। অনেক দেশে এসব আইন বদল করা হয়েছে কিন্তু এখনো অনেক বাকি। ইউরোপ-আমেরিকায় যখন আমরা “ইসলাম ন্যায়ের ধর্ম” বলি তখন এ-সব অন্যায় অত্যাচারী আইনের জবাব দেয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
আর একবার পড়ে নিন এ বইয়ের “পোহালে শর্বরী” অধ্যায়। খবর নিন আপনাদের মারোয়ানদের। ক্রমাগত দুর্বল রাজনীতির সুযোগে বিভিনড়ব কৌশলে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মারোয়ানের রক্তবীজ। এদের বড় একটা অস্ত্র হল ‘ইসলামের ওপর আক্রমণ’ বলে চেঁচামেচি করে এমন ভাব দেখানো যে ইসলাম রক্ষার সুমহান দায়িত্ব এখন তাদের ওপর এসে পড়েছে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব হাতিয়ে ইসলামের নামে অনৈসলামিক রাজাদের সিংহাসন রক্ষা, যা কোরাণ ও নবীজীর নির্দেশের সরাসরি বিরোধী। আমি সুস্পষ্ট ভাষায় জানাতে চাই ইসলাম-রক্ষার জন্য কাউকে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাতে হবে না। কারণ ইসলামের একজন বিপুল শক্তিশালী মালিক আছেন যিনি বলে রেখেছেন, “আমি এই উপদেশবাণী নাজিল করেছি, আমিই তা রক্ষা করব” (সুরা হির্জ ৯)। হ্যাঁ, তাঁরা মুসলমানের মঙ্গলের চেষ্টা করতে পারেন বটে।
অসংখ্য প্রমাণ থেকে এই বইতে অতি সংক্ষেপে আমি সাধ্যমত করলাম। আমার শারিয়া-সিডিগুলো, শারিয়া-তথ্যনাটক “বিধি ও বিধান” এবং শারিয়া-তথ্যসিনেমা “হিলা” ও “নারী” দেখুন — দলিলগুলোর জন্য যোগাযোগ করুন ও দলিলগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে দিন। যে কোন জাতির মত আমাদেরও সমস্যা অনেক। কিন্তু ইসলামের অপব্যাখ্যা এক মারাত্মক সমস্যা। নিজের অমূল্য কেতাবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে বিশ্ব-মুসলিমের আজ কি অবস্থা হয়েছে তা আমরা সবাই দেখছি। তাই ইসলামের অপব্যাখ্যাকে রোধ শুধু নয়, বাংলাদেশের জলস্থলের মাদুর থেকে শেকড় থেকে উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত আমাদের থামার উপায় নেই। কাজটা কঠিন নয়, শান্তির ইসলামের দলিলগুলো জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেই অনেকটা এগুনো হবে। অন্য কিছু মুসলিম-প্রধান দেশে এটা হচ্ছেও। দেশের রাজনৈতিক নেতারা যদি বিশ্বাসঘাতকতা করেনও, আমাদের সুফিদের দোয়া নিয়ে জনগণই ইসলাম ধরে রাখবে।
দেশে-বিদেশে ইসলামের নামে বোমাবাজীর তপ্ত সন্ত্রাসের নিন্দা করেন সবাই তারস্বরে। কিন্তু যে বিধিবিধান প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত নিঃশব্দে হত্যা করে দুনিয়ার সাড়ে ছয়শ’ কোটি মুসলিম নারীর মানবাধিকার আর শারিয়া-দেশগুলোতে ধ্বংস করে কোটি কোটি মুসলিম নারীর জীবন সেই শীতল সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলাটাও অত্যন্ত জরুরি। ওরা তো আমাদেরই বোন, ওদের কাতর আর্তনাদ আমাদের কানে কেন পৌঁছায় না ? আমাদের প্রত্যেকটি বোনকে কেন জীবন কাটাতে হবে হঠাৎ-তালাকের সম্ভাবনায়, হঠাৎ-সতীনের সম্ভাবনায় আর ‘শর্ত মানা গায়ে দাগ না পড়া’ প্রহারের সম্ভাবনায় ? আমাদের বোনদের চাক্ষুষ সাক্ষ্য কেন আদালতে নাকচ হবে, কেন আদালতে দরখাস্ত করতে হবে স্বামী যেন তাকে প্রতিদিন না মেরে সপ্তাহে একদিন মারে ? বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে আর কত ধর্ষিতা বালিকাকে জুতো খেতে হবে, কত নূরজাহান-ফিরোজাকে ধ্বংস হতে হবে জাতিকে এ-কথা জানাতে এ-আইন ইসলামি কি না ? ইসলামের ওপরে কলঙ্ক বয়ে আনা এ-সব ভয়াবহ ঘটনার বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ না করে কি করে নিজেদের দলকে ইসলামি বলে দাবি করতে পারেন আমাদের কিছু সংগঠন ?
পশু-পাখি-মাছেরা পশু-পাখি-মাছ হয়েই জন্মায়। কিন্তু মানুষ হয়ে উঠতে মানুষকে অনেক সাধনা করতে হয়। জীবনের বেশির ভাগ বোঝা মা-বোনেরাই হাসিমুখে বয়েছে চিরকাল। কিন্তু তার প্রতিদান তো দূরের কথা, স্বীকৃতিও পায়নি কোনদিন। আমরা পুরুষেরা নারীর জন্য যুদ্ধ করি, ধ্বংস করি, খুন করি, আবার আত্মহত্যাও করি। নারীর নামে আমরা তাজমহল বানাই, যক্ষ হয়ে মেঘদূত পাঠাই। নারীর বিরহে গান-গজল-কবিতায় সারা রাত জেগে থাকি আর ওদের খোঁপায় পরাই তারার ফুল। কিন্তু যে নারী পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে জন্ম দেয়, পালন করে হাসিমুখে নিরন্তর কষ্টে, জন্ম দিতে গিয়ে মরেও যায় অনেক সময়, যে নারী জন্ম দেয় নবী-রসুলকে তাদেরকে আমরা সংসারে-সমাজে-আইনে-বিধানে-সংগঠনে সমান অধিকার দিই না। এরই নাম পুরুষতন্ত্র। সমাজকে, সংস্কৃতিকে, সাহিত্যকে, রাষ্ট্রকে, আইনকে আর ধর্মকে আমরা পুরুষরা চিরকাল খুব চালাকির সাথে কাজে লাগিয়েছি ওদের শরীর আর সম্পত্তিকে কব্জায় রাখবার জন্য। ওদের শরীরের ওপর অধিকার আমরা কাউকে দিতে রাজি নই, এমনকি ওদেরকেও নয়। আমরা বুঝিনি, জীবনটা আসলে নারী-পুরুষ মিলে মধুর এক দ্বৈত-সঙ্গীত। জীবনে যে হতে পারত প্রিয়শিষ্যে ললিতে কলাবিধৌ, হতে পারত স্বর্গাদপি গরীয়সী জননী আর øেহময়ী ভগিনী তাকে ধর্মের নামে দুমড়ে মুচড়ে পায়ের নীচে পিষে পিষে আজ আমরা পুরুষরা দানবের মত একা হয়ে গেছি ॥