মোটেই নয়। শারিয়াপন্থীরা যতই বলুন শারিয়া-আইন বিশ্ব-মুসলিমের ঐতিহ্য কিংবা মোগল আমলেও ইসলামি আইন ছিল, মোটেই সত্যি নয়। শারিয়াপন্থীদের দাবির উদ্ধৃতি দেখুন বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ডের পৃষ্ঠা ৯ থেকে ঃ
১। “১৭শ’ শতকে সর্বপ্র ম মুগল সম্রাট আওরঙজেব আলমগীর সিংহাসনে আরোহণের চার বৎসর পর একটি রাজকীয় ফরমানের সাহায্যে ইসলামি আইনের একটি পূর্ণাঙ্গ সঙ্কলন প্রণয়নের নির্দেশ জারি করেন … সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইহাই ইসলামি আইনের সর্বপ্রম সঙ্কলন।”
২। তুর্কী উসমানী সরকার ১৮৬৯ সালে সাআদাত পাশার নেতৃত্বে একটি কমিটি … ১৮৫১ ধারা সম্বলিত ইসলামি দেওয়ানি আইনের একটি সঙ্কলন প্রণয়ন করে … এই সঙ্কলনটি প্রধানত ফাতাওয়া আলমগীরিকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করিয়া রচিত হইয়াছে … ১৯২৬ সাল পর্যন্ত তুর্কী সাম্রাজ্যে ইহা বলবৎ থাকে।
শারিয়াপন্থীরা এ-ও বলেন ঃ “ভারতবর্ষের মুসলিম শাসন আমলেও দেশে ইসলামি আইন প্রচলিত ছিল…আকবর তাঁর ষড়যন্ত্রমূলক এক অতি অভিনব ধর্ম প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু সেইসাথে তিনি এ উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্য তথা মুসলিম শাসনের অধঃপতনের বীজও বপন করেন। তার ফলেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর মাঠে মুসলিম শাসনের রবি অস্তমিত হয়” (জামায়াতে ইসলামির ইতিহাস, পৃঃ ৩ ও ১৯৮)। এ এক অভিনব ইতিহাস !! এবং মিথ্যা ইতিহাস।
আর আমরা বাঙালিরা নাকি নৃতাত্ত্কি দিক দিয়ে আরবি। বঙ্গ নামটাও নাকি আদি মুসলিম থেকেই এসেছে − দৈনিক ইনকিলাব ১২ই নভেম্বর ২০০৭ ও ২৫শে জুন ২০০৮। রাজনৈতিক শারিয়াপন্থীরা ভালভাবেই জানে যে একটা মিথ্যেকে বারবার এবং বারবার বলতে থাকলে কিছু মানুষের মনে সেটা ধীরে ধীরে সত্য হয়ে ওঠে, দৈনিক পত্রিকায় হলে তো সোনায় সোহাগা। অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত জনগণের বেলায় এটা আরো সত্যি। রাজনৈতিক শারিয়াপন্থীরা ভালভাবেই জানে যে তারা মিথ্যে বলছে। তারা এ-ও জানে যে আলোকিত লোকেরা তাদের এ মিথ্যে বুঝতে পারে। কিন্তু তারা এ-ও জানে যে আলোকিত লোকেরা বুঝতে পারলেও এ মিথ্যে বলার জন্য তাদের কোন শাস্তি হবে না। এবং তারা এ-ও জানে যে আলোকিত লোকেরা বুঝতে পারলেও অনালোকিত যত লোককে প্রভাবান্বিত করে কব্জা করে যায় ততই তাদের ভোটেও লাভ, মিছিলেও লাভ। এরকম বহু ষড়যন্ত্র চলছে আমাদের মাতৃভূমিকে মরুভূমির অপসাংস্কৃতিক উপনিবেশ করার জন্য। বেশ কিছু ষড়যন্ত্র সফলও হয়েছে। পাকিস্তানে এ ষড়যন্ত্র পুরোপুরিই সফল হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, ব্র“নাই, রাশিয়া, চীন, ইউরোপ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানে কখনোই শারিয়ার শাসন ছিল না। ভারতবর্ষে মোগল বা সুলতানী আমলে তো ছিলই না। সারা ভারতবর্ষে শত শত বছরে চোরের হাত কাটা কিংবা পাথর মেরে হত্যার শাস্তি একটাও নেই। তাহলে আর শারিয়া-রাষ্ট্র কোত্থেকে হল ? রিচার্ড ইটন ভারতে ইসলামের ওপরে বিশ্ব-নন্দিত পণ্ডিত, তিনি বলেন ঃ “ধর্মীয় সংস্কৃতির দিক দিয়ে বাংলার মুঘলদের তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল − চিশতি-তরিকার প্রতি বিশেষ সম্বন্ধ, ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ ও অমুসলমানদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করায় তাঁদের অনীহা। … আলাউদ্দীন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) ও তাঁর পুত্র নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ (১৫১৯-১৫৩২)-এর আমলকে সাধারণভাবে বাংলার স্বর্ণযুগ বলা হয়। হুসেন শাহ-এর সময়ে হিন্দুরা উলেখে যাগ্য সংখ্যায় সরকারে কর্মরত ছিলেন, যেমন তাঁর প্রধান মন্ত্রী, প্রধান দেহরক্ষী, ব্যক্তিগত-একান্ত সচিব, ব্যক্তিগত রাজ-চিকিৎসক, অর্থশালা-প্রধান ও চট্টগ্রামের গভর্নর…।” (The Rise of Islam and the Bengal Frontier – 1204-1780)।
একই কথা বিস্তারিত বলেছেন রামমোহন রায় কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ডঃ তেসলিম চৌধুরী ঃ “মুঘল শাসনে (১৫২৬-১৭০৭) ভারতবর্ষ কখনো ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হতে পারেনি … (মুসলিম) খলিফার প্রাধান্য অস্বীকার করে বাবর যে সার্বভৌম রাজত্বের সূচনা করেন তা রক্ষণশীল সম্রাট আওরঙজেব পর্যন্ত অক্ষুণড়ব রাখেন … মুঘল শাসনের সাথে ধর্মরাজ্যের কোন মিল নেই…মুঘলরা দেশ ও কালের প্রয়োজন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় নীতি প্রবর্তন করেন … আওরঙজেব সিংহাসনে বসেন ১৬৫৮ সালে, ২১ বছর পর জিজিয়া প্রবর্তন করেন ১৬৭৯ সালে ও ১০ বছর পর ১৬৮৯ সালে দাক্ষিণাত্যে জিজিয়া রহিত করেন … শাহজাহানের সময় ১১০ জন হিন্দু মনসবদার ছিল, আওরঙজেবের সময় ছিল ১০৫ জন, তার মধ্যে ৭০০০-হাজারি মনসবদার ছিল জয়সিংহ ও যশোবন্ত সিংহ − মোঘল আমলে এটা এই প্রম…বাংলায় আকবরের আমলে ৯ জন, জাহাঙ্গীরের আমলে ৫১ জন এবং আওরঙজেবের আমলে ১৬০ জন উচ্চপদস্থ হিন্দু কর্মচারী ছিল…মুঘল শাসনে বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ঘটে … (তার আগে বাংলার সুলতানি আমলে ৭১২- ১৫২৬) সুলতানি শাসন সম্পূর্ণ আলাদা ছিল, মদ্যপান ও অবৈধ বহু নারীসঙ্গ এগুলিকে ভোগবিলাসের উপকরণ হিসেবে সুলতানগণ কমবেশি গ্রহণ করেছিলেন” (মধ্যযুগের ভারত, ১ম ও ২য় খণ্ড, বিভিনড়ব পৃষ্ঠা)।
মোগল-দরবার ভরা ছিল অমুসলিম রাজন্য-আমাত্য দিয়ে আর অন্তঃপুরে অনেক সময়ই ছিলেন অমুসলিম রাণীরা − যাঁদের বিয়ে করা ইসলামে অবৈধ। তাঁরা অমুসলিম উৎসবগুলোও পালন করতেন রাষ্ট্রীয়ভাবে, যেমন দিওয়ালী, নওরোজ, ইত্যাদি। মোগল আমলে ইসলামি শাসন ছিল না সেটা মওলানা মওদুদিও জানতেন। তাই তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন ঃ “যদি এই ইসলামই (অর্থাৎ শারিয়া-ভিত্তিক ইসলাম) ভারতের বুকে পেশ করা হতো এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যাঁরা বাইরে থেকে এসেছিলেন এবং এখানে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা যদি চেষ্টা করতেন তাহলে ভারতের চিত্র অন্য রকম
হতো” (পাঠানকোটের বক্তৃতা − ১৯, ২০ ও ২১শে এপ্রিল, ১৯৪৫)। মোগল শাসনকে শারিয়াপন্থীরা “ইসলামী শাসন” হিসেবে খুব দাবি করেন কিন্তু ইতিহাসে পাওয়া যায় ঠিক উল্টো ঃ “লক্ষ্য করা দরকার যে, জন্মসূত্রে সুনিড়ব হইলেও সম্রাট হুমায়ুন শের শাহ্-এর কাছে রাজ্য হারাইবার পর তাহা উদ্ধারে ইরাণী সম্রাটের সাহায্যপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত হিসেবে শিয়া ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। … ইরাণের সম্রাট হুমায়ুনের সম্মানে এক ভোজের আয়োজন করেন … সম্রাট জাহাঙ্গীরের মাতা ছিলেন হিন্দু … তাঁহার দুই হিন্দু মহারাণী মানবাঈ ও মহারাণী জগতের প্রবল প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল … আওরঙ্গজেব বাজীপুর, হায়দ্রাবাদ ও লক্ষেèৗ-এর মুসলিম নবাবদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেন।”
রাণীরা হিন্দু কিন্তু রাজত্ব ইসলামি ? হতে পারে এটা ? এর ফলেই আমরা মুঘল দরবারে ইরাণের ফার্সী ভাষার প্রাধান্য দেখি যা ভারতের মুসলমানদেরকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। আজো ফার্সী ভাষার “খোদা”, “নামাজ”, “রোজা” ইত্যাদি বহু ফার্সী শব্দ আমাদের ইসলামী ঐতিহ্য হয়ে রয়েছে অথচ খোদ আরবের লোকেরা ওগুলো বোঝেও না। ওগুলোর আরবী শব্দ হলো যথাক্রমে আলাহ, সালাত, ও সায়েম।
বাঙালি বুদ্ধিমান জাতি। রাজা মুসলমান হলেই সেটা ইসলামী রাষ্ট্র হয় না তা জাতি ঠিকই বোঝে। ঘটা ক’রে যতই “বখতিয়ার খিলজী দিবস” পালন করা হোক না কেন ওটা যে একটা যুদ্ধমাত্র ও তার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই সেটাও জাতি বিলক্ষণ বোঝে। সিরাজুদ্দৌলাও তাই। সিরাজুদ্দৌলার শাসন ‘মুসলিম শাসনের রবি’ ছিল বলে দাবি করেন অনেকে। কিন্তু রাজ-দরবারে সর্বোচ্চ পদগুলোতে দাপটের সাথে কাজ করেছে মাণিকচাঁদ, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, কৃষ্ণবলভ, রাজবলভ, রায়দুর্লভ, নন্দকুমার প্রমুখ অমুসলিমের দল। সেনাপতির ওপরেই রাজাদের মাতব্বরি চলে। সিরাজের সেনাপতি ছিলেন বিশ্বস্ত হিন্দু ও কাশ্মীরী দুই সেনাপতি মীরমদন ও মোহনলাল। তাঁরা ক্লাইভ ওয়াটসন-কিলপ্যাট্রিকের হাতে প্রাণ দিয়েছেন কিন্তু নবাবকে ছেড়ে পালাননি। আর মীরজাফর পলাশীর সেই ঘোর নিয়তির সময় কোরাণ হাতে (শোনা কথা, সম্ভবত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে আছে) নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করার কসম খেয়েছিল, যার বিশ্বাসঘাতকতায় আমরা পরাধীন ছিলাম ১৯০ বছর। বাংলার ইতিহাসে চোরের হাতকাটা বা পরকীয়ার পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড একটাও নেই। বাংলার ইসলাম প্রচারকরা বাংলার ধারেকাছে শারিয়া আইনকে আসতে দেননি ॥