দুনিয়ায় হাজার হাজার বিশ্বাস-ভিত্তিক দাবি চালু আছে। শারিয়াপন্থীদের শারিয়ায় বিশ্বাসের মত একই বিশ্বাসে কোটি কোটি হিন্দু বিশ্বাস করে মানুষের শরীরে হাতির মাথা নিয়ে গণেশ হল সিদ্ধিদাতা, ও-থেকেই নাকি আজকের অর্গ্যান ট্র্যান্সপ্যাণ্ট এসেছে যেমন একজনের চোখ বা হৃৎপিণ্ড বা কিডনী অন্যের দেহে লাগানো। রামায়ণের যুদ্ধে রাবণ আকাশের পুষ্পক রথ থেকে রামের ওপরে অগিড়ববাণ মেরেছিল। এ-থেকেই নাকি আজকের ফাইটার পেন আর ব্যালিস্টিক মিসাইলের জন্ম। যুগ যুগ ধরে অনেকে এধরনের ভিত্তিহীন দাবি করেছেন শারিয়া সম্বন্ধেও। কিছু বিষয় আগের অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করেছি, বাকি কয়েকটা তুলে দিচ্ছি।
- আলাহ এক। শারিয়া আলার আইন হলে আইন একটাই হতো, চার-পাঁচ রকম হতো না। বিভিনড়ব শারিয়ার মধ্যে পার্থক্য, বিরোধ বা উল্টো আইনও থাকত না।
- শারিয়ার কি কি আইন কোরাণের কোন্ কোন্ আয়াতকে ও তার পটভূমিকে লঙ্ঘন করে তার কিছু উদাহরণ দেখানো হয়েছে, আরও আছে আমার Banglarislam.com ওয়েবসাইট-এ। শারিয়া আইন যদি আলার হয় তবে তা আলার কোরাণকে লঙ্ঘন করার প্রশড়বই ওঠে না।
- ইমাম মালিক-আবু হানিফা-হাম্বল-শাফি’র মধ্যে বিপুল মতবিরোধ ছিল। এ-সব বিরোধের সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন ইমাম শাফি’ তাঁর ‘রিসালা’ বইতে, কিন্তু তিনিও ইরাক থেকে আরবে গিয়ে একবার, আর আরব থেকে মিশর যাবার পরে দ্বিতীয়বার তাঁর ব্যাখ্যা বদলেছেন। আলার আইনে এ-সব পরিবর্তনও হয় না, বিরোধও হয় না, এবং সে বিরোধ মানুষের মেটানোর প্রশড়বও ওঠে না।
- কোরাণে শাশ্বত সামাজিক আইনের আয়াত কয়টা এই মূল ব্যাপারেও একমত হতে পারেননি বিশেষজ্ঞ বা আলেমরা। যেমন ঃ (১) অনেকে বলেছেন শূন্য − (মওলানা চিরাগ আলী থেকে শুরু করে ইমাম বোখারী পর্যন্ত − এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা ১৯৮৩)। আমি জানি না কি করে এটা হয় কারণ মদ্যপান কিংবা শূকরের মাংস নিষিদ্ধ, এটা চিরকালের সামাজিক আইন। কেউ কেউ অবশ্য প্রশড়ব করতে পারেন নিতান্ত বাধ্য হলে প্রাণ বাঁচানোর জন্য সেটাও সামান্য খাবার অনুমতি কোরাণে আছে। (২) আশি − ডঃ তাজুল হাশমী। (৩) দুইশ’ − ইমাম শাফি’র রিসালা। (৪) সাড়ে তিনশ’ − প্রিন্সিপল্স্ অব্ ইসলামিক জুরি¯প্র“ডেন্স পৃষ্ঠা ২৬। (৫) পাঁচশ’ − শারিয়া দি ইসলামিক ল’ পৃষ্ঠা ৭ ও কুরাণিক ল’ অব্ ক্রাইম্স্ পৃষ্ঠা ৬ ইত্যাদি। এর মধ্যে কোন্টা আলাহ’র আইনের আয়াতের আসল সংখ্যা ? যার মূল বিষয়েই এত বেশি মতভেদ তাকে আলার আইন হিসেবে দাবি করা যায় না।
- শারিয়াপন্থীরা মনে করেন আলাহ বড় মেহেরবানি করে মানুষকে শারিয়া দিয়েছেন যাতে সব অমুসলিম-রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে শারিয়ার ভিত্তিতে দুনিয়াময় ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করে মানুষ সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা জানি আরও হাজারটা জিনিস আইনের চেয়ে ঢের বেশি দরকার অথচ আলাহ সেগুলো সরাসরি দেননি। কাল সকাল থেকে দুনিয়ার সব কাপড় উধাও হয়ে গেলে কি ভয়াবহ অবস্থা হবে ? মানুষ বাইরে বেরুতে পারবে না, অফিস-কল- কারখানা হাট-বাজার বাস-ট্রেন-পেন- লঞ্চ-স্টীমার পোস্ট-অফিস সব বন্ধ হয়ে যাবে, বাড়ির ভেতরেও মানুষ বাবা-মা ভাই-বোন ভাবী-দুলাভাই চাচা-চাচী কারো সাথে থাকতে পারবে না। এমন অতি দরকারি জিনিসটাও যখন মানুষকেই বানিয়ে নিতে হয়েছে আলাহ আশমান থেকে তৈরি করে পাঠাননি, তখন আলাহ কেন রাষ্ট্র চালানোর আইন বেহেশ্ত্ থেকে তৈরি করে পাঠাবেন ? শত-লক্ষ-কোটি বছর ধরে কোটি কোটি বাবা-মায়ের চোখের সামনে বাচ্চারা, বাচ্চাদের সামনে বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীর সামনে ভাই-বোন স্বামী-স্ত্রী সহ কষ্ট পেয়ে ডায়াবেটিস-ম্যালেরিয়া-বসন্ত-পেেগ কাতরাতে কাতরাতে মরে গেছে, আলাহ্ বেহেশ্ত্ থেকে কোন ওষুধ তৈরি করে পাঠাননি। আগুন, ভাষা, পাস্টিক বা রবার ছাড়া দুনিয়া এক মুহূর্তে অচল হয়ে পড়বে। কিন্তু তবুও সরাসরি আলাহ ও-সবের কোনকিছুই দেননি, দেবেনও না। মানুষের দরকার পূরণের জন্য তিনি দিয়েছেন দু’টো অপবূর্ অ¯্র¿ − বুদ্ধি আর বিবেক। দিয়ে বলেছেন যাও, এখন চরে খাও, আর শয়তানের হাত থেকে বেঁচে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ কর, আখেরে আমি কাহ্হার (প্রচণ্ড পাকড়াওকারী) হয়ে ধরব। মানুষ প্রয়োজনমত সবকিছু আবিষ্কার করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। কাজেই আলাহ্মা নুষকে বাকি সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু রাষ্ট্র চালানোর আইন দিয়েছেন তা হতে পারে না।
- “এমনকি খুলাফায়ে রাশেদীন বিচারক হিসেবে ইজতিহাদের ভিত্তিতে যে-সব রায় প্রদান করিয়াছেন তাহাও শরিআতে আইন হিসেবে স্বীকৃত নহে” (বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড ২য় ভাগ পৃঃ ১৩)। যদি নবীজীর পরে স্বয়ং সাহাবী খোলাফায়ে রাশেদীনের সিদ্ধান্তই ‘আলার আইন’ হতে না পারে তবে এক-দেড়শ’ বছর পরের অন্যান্য ইমামদের ব্যক্তিগত মতামতও ‘আলার আইন’ হতে পারে না।
- সুদূর অতীতের সেই বিশেষ সময়ের বিশেষ সমাজের বিশেষ ঘটনার নির্দেশকে সবার ওপরে চিরকাল চাপিয়ে দিলে ক্ষতি হতে বাধ্য, যে ক্ষতি শারিয়ায় প্রতিফলিত। এ-কথা মওলানা মুহিউদ্দিনের বাংলা কোরাণেও আছে − “কালের পরিবর্তন মানবস্বভাবের উপর প্রভাব বিস্তার করে। যদি সবার জন্য শাখাগত বিধান এক করে দেয়া হয় তবে মানুষ গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে … আসল সত্য হচ্ছে এই যে, বিগত দিনগুলোতে সে ব্যবস্থাপত্রই নিভুর্ল ও জরুরী ছিল এবং পরবর্তী পরিবতির্ত অবস্থায় পরবর্তী পরিবতির্ত ব্যবস্থাপত্রই নিভুর্ল ও জরুরী” ইত্যাদি (পৃঃ ৩৩৪)।
- বর্তমানেও যেখানে শারিয়ার শাসন চলছে তার প্রত্যেকটিতে নারীদের ও অমুসলিমদের মানবাধিকার প্রচণ্ডভাবে লঙ্ঘন হয়। আলার আইন হলে এমন হতে পারত না।
- নবীজী ইসলামের অনেক ইসলামি সিদ্ধান্তকে অন্যদের কাছে পৌঁছাতে বলেছেন কিন্তু যে-সব আইনগত সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতে হয়েছিল সেগুলোকে তিনি কখনো অন্যদের কাছে পৌঁছাতে বলেননি কারণ তিনি জানতেন এক যুগের এক সমাজের আইন অন্য যুগে অন্য সমাজে খাটালে বিপদ হতে বাধ্য।
- শারিয়াকে রাষ্ট্রের আইন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে সঙ্কলন করা হয় মাত্র সেদিন, ১৭শ’ সালে ভারতে আওরঙজেবের আমলে “ফতোয়া-এ আলমগিরি” ও ১৮৬৯ সালে তুর্কী খলিফা সা’দত পাশা’র আমলে।
- শারিয়া আলাহ’র আইন হলে ইসলাম-প্রচারকেরা যেখানে জমিদারদের সাথে লড়াই করে বিজয়ী হয়েছিলেন সেখানে শারিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করতেন। কিন্তু এমন একজন প্রচারকও পাওয়া যায় না যিনি শারিয়া আইন প্রচার করেছেন। অর্থাৎ শারিয়া আইন ইসলামি ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ নয়।
- শারিয়ায় কখনো জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়নি, জনগণকে কখনো কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়নি। সে হিসেবে শারিয়া হল গণবিচ্ছিনড়ব স্বৈরতন্ত্র (হিউম্যাান রাইট্স্ ইন্ মুসলিম ওয়ার্লড − ডঃ মায়মুল খান, পৃঃ ৯৪)। বর্তমান বিশ্বে এ-সব আইন অচল কেন তা আইনের উদাহরণ অধ্যায়ে আইনগুলো নিজেই বলবে।
- আমাদের জন্য শারিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র বৈধ হলে ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র বা ইসরাইলে ইহুদীরাষ্ট্র বা পশ্চিমে খ্রীষ্টানরাষ্ট্র কেন বৈধ হবে না ? কেন ওগুলোকে উস্কে দেয়া হবে না ?
কোনো এক শারিয়া-বিরোধী মওলানা বলেছিলেন ঃ “কোরাণের দুনিয়াবী সব আয়াত পানির মত স্পষ্ট বুঝি, কিন্তু ঐ একই আয়াতগুলোর তফসিরগুলো পড়লেই মনে হয় আফ্রিকার জঙ্গলে ঢুকে গেলাম।” মহাকবি ইকবাল পরিহাস করে বলেছিলেন ঃ “আমাদের মোলা- মওলানাদেরকে অনেক ধন্যবাদ, তাঁরা আলাহ- রসুলের বাণী আমাদের কাছে পৌঁছিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা সে বাণীর যে চেহারা করেছেন তাতে আলাহ- রসুল পর্যন্ত তাজ্জব হয়ে গেছেন !” কিন্তু তা হলে তো চলবে না ! কোরাণের বাণী খুব স্পষ্ট (সুরা ইমরান ৭ ও আরো বহু আয়াত), দুনিয়াবী ব্যাপারে প্রতিটি আয়াত একটা ষোল বছরের বাচ্চাও বুঝতে পারবে। কিন্তু কোরাণের বাণী খুব সংবেদনশীলও, অর্থাৎ মূলে সামান্য তফাৎ হলেই পরিবর্তী ফলাফল বিপুলভাবে বদলে যাবে। ঠিক তেমনি, শারিয়া-তত্ত্বটা দাঁড়িয়ে আছে কোরাণের মূল দর্শনটার অতি সূক্ষ্ম পরিবর্তনের ওপর যা ভক্ত মনের পক্ষে ধরা কঠিন কিন্তু ফলাফলে আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়ে যায়। সে পার্থক্যটা আমরা দেখি হজরত শাহ-জালাল আর গোলাম আজমের মধ্যে, নিজামুদ্দীন আওলিয়া আর মওদুদির মধ্যে। এঁদের ইসলাম পরস্পরবিে রাধী।
অনেক সময় অত্যাচারী বুদ্ধিমানেরা আইনের মারপ্যাঁচে আদলতের শাস্তি এড়িয়ে যায় বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষ ঠিকই বুঝতে পারে সে অপরাধী। কিন্তু ধর্মের ও আলাহ’র নামে অত্যাচার হলে মানুষ বুঝতে পারে না কিংবা বুঝতে চায় না যে ওরা আসলে অপরাধী। কখনো শাস্তি হয় না বলে ওদের সাহসও অনেক। সেজন্যই ওরা ভয় দেখায়, মানুষ ভয় পায় বলে ওরা আরো ভয় দেখায়। কেন ওরা শাস্তি পায় না ? কারণ, ওদের শাস্তি দেবার আইনটাই এখনো বানিয়ে উঠতে পারেনি মানুষ। তাছাড়া ওরা মানুষকে কষ্ট দেয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, লেবাস, উপাসনালয়ের ভেতরে থেকে। এ-সব দেখেই সাধারণ মানুষ ভোলে বেশি। তাছাড়া ওদের প্রতিরোধ করতে গেলে ওরা ‘ধর্মে আঘাত হানা হচ্ছে’ বলে চেঁচামেচি জুড়ে দেয় ও খুনখারাপি শুরু করে। এ বড় কঠিন ফাঁদ।
কিন্তু যত কঠিনই হোক, এ ফাঁদ থেকে একদিন উঠে আসবে মানুষ। উঠে আসতেই হবে তাকে। আর সেজন্যে ফাঁদটার চেহারা-স্বরূপ, স্বভাব-প্রকৃতি জানা খুব দরকার। ইসলাম সহজ সরল ধর্ম, তাই কোরাণের ঘটনা-নিরপেক্ষ মানবিক মূল্যবোধের আয়াতগুলো নিয়ে শারিয়া বানালে তখনই বিশ্ব-মানবকে গণতন্ত্র আর ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব্ হিউম্যান রাইট্স্ দিতে পারত মুসলমানেরাই। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর গঠনতন্ত্রে আর ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব্ হিউম্যান রাইট্স্-এর ১৮ নম্বর আর্টিকেল-এ হুবহু কোরাণের মর্মবাণী লেখা আছে − লা ইক্রাহা ফিদ-দ্বীন, লা’কুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন। দুর্ভাগ্য, হিংসায় উন্মত্ত পৃ ¡ীতে বিশ্ব-শান্তির অন্তত একটা দিগ্দর্শন যা থেকে পাওয়া যেত, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সেই চমৎকার আয়াত দু’টোর জায়গা হয়নি শারিয়ায়।
আলার ইবাদতের নামে শারিয়া-রাষ্ট্রগুলোতে অসংখ্য নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে চলেছে। শারিয়া আসার আগে ওসব দেশের লোকেরা আমাদের মতই মনে করত ওদের দেশে এসব অসম্ভব। এখন অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া ওদের আর কিছু করার নেই কারণ ওরা দেখে শেখেনি − এখন ঠেকে শিখছে। মা-বোনের ওপর এরকম হাজার হাজার হৃদয়বিদারক নিষ্ঠুর ঘটনা নাম-ধাম সহ ধরা আছে উইমেন লিভিং আণ্ডার মুসলিম ল’-এর ওয়েবসাইট http://www/wluml.org/english/index.shtml ।আমরাও যদি দেখে না শিখি তবে ভয়ানক মূল্য দিয়ে ঠেকে শিখতে হবে ॥