বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ডে আছে ঃ “তাঁহারা (ইমাম আবু হানিফা ও তাঁহার সহচরবৃন্দ) কেবল সমকালে উদ্ভূত সমস্যার আইনগত সমাধান পেশ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, বরং ভবিষ্যতে কি ধরনের সমস্যার উদ্ভব হইতে পারে এবং তাহার সমাধানই বা কি হইতে পারে তাহাও তাঁহারা গবেষণা করিয়া স্থির করিয়া উহার আইনগত সমাধান নির্ণয় করিয়াছেন” (বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ৮)।
সম্ভব ?
না, সম্ভব নয়। দু’শো, পাঁচশ’, দশ হাজার, ত্রিশ লক্ষ এবং পঞ্চাশ কোটি বছর পরের বিশ্বব্যাপী তাবৎ মুসলিম সমাজের তাবৎ সমস্যার সমাধান দিতে পারে না কেউ। তাছাড়া, এ-কথা ঠিক হলে ইজমা, কেয়াস, রাই, ইস্তিসান, ইস্ততিসলাহ ইত্যাদির কি হবে ? শ্লোকেও বলে, “পুরুষস্য ভাগ্যম্ দেবা ন’ জানন্তি, কু’তো মনুষ্যাঃ” (‘স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম’টা বাদ দিচ্ছি, ওতে মা-বোনদের প্রতি কুৎসিৎ শেষ আছে)। অর্থাৎ দেবতারাও ভবিষ্যৎ জানে না মানুষ তো কোন্ ছার। আমরা চাই আমাদের শারিয়া-পণ্ডিতেরা কোরাণ-সুনড়বতের আলোকে নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধি খাটিয়ে যুগোপযোগী মুসলিম-আইন বানাবেন। কিন্তু তাঁরা তা না করে মরণপণ ছুটেছেন লক্ষ লক্ষ পৃষ্ঠা ঘেঁটে হাজার বছর আগে কে কি করেছেন তা বের করে তার ফটোকপি আজকের সমাজে প্রয়োগ করতে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মত বিশাল বিপুল ঘটনা বিশ্ব-ইতিহাসে কমই আছে। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে মাত্র ৩৫ বছরে সে-ইতিহাস, সে-দলিলের যা হাল হয়েছে তাতে আগামী প্রজন্মের পক্ষে নিজেদেরই এত বড় গৌরব সম্বন্ধে বস্তুনিষ্ঠ সত্য পাওয়া অসম্ভব হয়ে গেছে। একই কথা খাটে মুসলিম খেলাফত সম্বন্ধেও − জনকয়েক জ্ঞানী খলীফা ছাড়া ১৪০০ বছরের সে দীর্ঘ ইতিহাস মুসলমানের হাতে অসংখ্য মুসলমানের ষড়যন্ত্র, ক্রমাগত গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যায় পরিপূর্ণ। মুসলিম ইতিহাসে আমরা কমপক্ষে ২০টি রাজতন্ত্র দেখি ‘ইসলামের খলিফা’ হিসেবে, পরস্পরের সাথে ক্ষমতার লড়াইয়ের কামড়াকামড়ি করতে। সেই ষড়যন্ত্র, সেই ক্ষমতার লড়াইয়ে কোন্ দলিলের কি হাল হয়েছে তা আজ বলা সম্ভব নয়। আর, চিরকালের ভবিষ্যতের জ্ঞান সম্বন্ধে আমাদের কোরাণ কি বলছে ? বলছে − যুক্তির কথা, সাধারণ জ্ঞানের কথা।
- সুরা হুদ ৩১ ঃ হজরত নূহ − “এ কথাও বলি না যে আমি গায়েবী খবরও জানি।”
- ক্স সুরা আরাফ ১৮৮ ঃ খোদ নবীজী − “আমি যদি গায়েবের কথা জানিয়া লইতে পারিতাম তাহা হইলে বহু মঙ্গল অর্জন করিতে পারিতাম।”
- সুরা আন-নমল ৬৫ ঃ “বলুন, আলাহ ব্যতীত নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে কেউ গায়েবের খবর জানে না।”
- ক্স সুরা লোকমান ৩৪ ঃ “কেউ জানে না আগামী কল্য সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন দেশে সে মৃত্যুবরণ করবে।”
হলো ? ‘আলীমুল গায়েব’ (অজানার জ্ঞানী) আমরা বলি আলাহ্ে ক, কোন মানুষকে নয়। স্বয়ং নবীজী বলেছেন “আগামী কাল আমার কি হবে আমি জানি না”- আহক্বাফ ৯। এর ব্যাখ্যায় মওদুদি এটা সমর্থনও করেছেন ঃ “আমি অদৃশ্য কিছু জানি না যে দুনিয়ার সবকিছু জানিব কিংবা অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবকিছু বলিতে পারিব। তোমাদের ভবিষ্যৎ দূরের কথা আমি আমার নিজের ভবিষ্যৎও জানি না” − ওয়েবসাইট তাফহিমুল কুরাণ। ক্যানাডার সম্মানিত ও বিখ্যাত ইমাম শেখ আহমেদ কুট্টি বলেছেনঃ http://www.alislamforall.org/Misc/islamonm.htm − (সহি বোখারী ঃ ডঃ মহসীন খান – ভল্যুম ৭ হাদিস নং ৭৭) “এক বিবাহ অনুষ্ঠানে যখন বালিকারা গাহিতেছিল ‘আমাদের মধ্যে এক রসুল আছেন যিনি জানেন আগামীকাল কি ঘটিবে’ তখন তিনি তাহাদিগকে থামাইয়া বলিয়াছেন ‘এই বাক্যটি বাদ দাও এবং গাহিতে থাক।’” হাদিসেও আমরা একই তথ্য পাই − “এখন আমি যাহা জানি তাহা যদি আগে জানিতাম…” (সহি ইবনে মাজাহ ৪র্থ খণ্ড ৩০৭৪)।
কেউ কেউ বলেন, শারিয়া বানাবার জন্য ভবিষ্যতের ইলহাম আলাহ্শা রিয়া-ইমামদের দিয়েছেন। কিন্তু “যেহেতু ইলহাম শুধুমাত্র মনের চিন্তা, তাই ইহাতে অন্যকছুর মিশ্রণ বা ভুল থাকিতে পারে। কাজেই ইলহাম কোন আইন বা পদ্ধতির ভিত্তি হইতে পারে না” (ইমাম শাফি’র শারিয়া কেতাব “উমদাত্ আল সালিক” পৃঃ ১০১৮)। আর, ইলহাম পাওয়াটা তো চোখে দেখা যায় না, তাই বাস-ট্রেনের “তারা মার্কা কৃমি-রাক্ষসী”র বিক্রেতার মত কে কি মতলবে কি ইলহাম দাবি করছে তা বলা বড্ড মুশকিল। আমাদের বরিশাল-ভোলার প্রিন্সিপ্যাল আলহাজ্জ মৌঃ সুফী হাবিবুর রহমান সাহেব এম.এ. ১৯৪৮ সালের ১৮ই জুন শুক্রবার রাতে স্বপ্নে আল্লাহকে পালকি চড়তে দেখেছেন (হাকীকত-খনি পৃঃ ১৩৪)। এধরনের ভয়াবহ সম্ভাবনা বুঝেই ইমাম শাফি আমাদের ওপরের হুঁশিয়ারিটা দিয়ে গেছেন। তাছাড়া শারিয়ার ক্ষেত্রে আমরা তো এক-আধটা ইলহামের কথা বলছি না, অনন্ত ভবিষ্যতের অন্তহীন সমাজের অসংখ্য ঘটনা-অপরাধের কথা বলছি। তেমন অনন্ত অসীম ইলহাম একেবারেই অবাস্তব।
ঠিক সেজন্যই কোরাণ থেকে মূল্যবোধ নিয়ে শারিয়াকে পরিবর্তিত হতে হবে যুগের সাথে। বহু ইসলামি নেতা এ-কথা বলা শুরু করেছেন, বিশ্ববিখ্যাত হাসান তোরাবী তাঁদের একজন। তিনি বলেন, “লোকে ভ্রান্তভাবে মনে করে শারিয়া হল আইন। কিন্তু আসলে শারিয়া হল জীবন-পদ্ধতি” − সুদান ট্রিবিউন ০৬ জুন, ২০০৬ ॥