shariakibole.com

শারিয়ায় নারী-সাক্ষী

সাক্ষ্য কি ? সাক্ষ্য হল, কোন লোক কোন অপরাধ ঘটতে দেখল এবং আদালতে বিচারকের সামনে সেটা বয়ান করল। বাঘা অপরাধীও ওটাকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। কেন জানেন ? কারণ হল − অপরাধীর বিরুদ্ধে চাক্ষুষ সাক্ষী সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র। সেজন্যই অপরাধীরা সাক্ষীকে খুন পর্যন্ত করে ফেলে। শুধুমাত্র সাক্ষীর জোরেই অপরাধীর শাস্তি হয়, সাক্ষীর অভাবে সত্যিকারের অপরাধীও ছাড়া পেয়ে যায়। এ-ছাড়াও আছে বিশ্বাসের সাক্ষ্য − “লা ইলাহা ইলালাহু মুহম্মদুর রসুলুলাহ − আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আলাহ একমাত্র মাবুদ আর মুহম্মদ তাঁর রসুল।” এ-সাক্ষ্য ছাড়া মুসলমানই হওয়া যায় না। বিদায় হজ্বে তাঁর শেষ ভাষণে নবীজীও সবার কাছ থেকে সাক্ষ্য নিয়েছিলেন − “আমি কি আলার বাণী তোমাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি ?” লক্ষ লক্ষ হাত আকাশে উঠে ঘোষণা করেছিল − “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, ইয়া রসুলুলাহ। ” নবীজী বলেছিলেন − “সাক্ষী থাক, আমিও সাক্ষী থাকলাম।” সে-জন্যই খোদ কোরাণও বলেছে সাক্ষ্য গোপন না করতে − বাকারা ২৮৩, মায়েদা ১০৬, ইমরান ১৬১, ইত্যাদি।

এই হলো ইসলামে সাক্ষ্যের মর্যাদা, এই হলো আদালতে সাক্ষ্যের উপকারিতা। এতে নারী-পুরুষ কোনই ভেদ নেই। একটা প্লেটে যদি কোন মানুষের চোখ রাখা হয় তবে কেউ বলতে পারবে না ওটা পুরুষের চোখ না নারীর। গাছের আম পুকুরের মাছ আকাশের তারা পুরুষ যেমন দেখে নারীও হুবহু ঠিক তেমনি দেখে। ডাকাতি বা খুন চোখের সামনে হলে পুরুষ যা দেখে নারীও তাই দেখে। তাই সাক্ষ্যের ব্যাপারে নারী-পুরুষের কোনই ভেদাভেদ থাকার কথা নয়। এবারে চলুন দেখি শারিয়া-আইন পুরুষ ও নারীর সাক্ষ্যের মধ্যে কোনো তফাৎ করে কি না।

হুদুদ মামলায় নারী-সাক্ষ্য চলবে না চারজন মুসলমান পুরুষ সাক্ষীর প্রয়োজন এ-আইন আছে হানাফি আইন ১৭৬ ও ৩৫৩ পৃঃ, শাফি’ই আইন পৃঃ ৬৩৮,Law #o.24.9, মওলানা মুহিউদ্দিনের বাংলা কোরাণ পৃঃ ২৩৯ ও ৯২৮,ক্রিমিনাল ল’ ইন ইসলাম অ্যাণ্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড পৃঃ ২৫১, পেনাল ল’ অফ ইসলাম পৃঃ ৪৪, ৪৫ ইত্যাদিতে। কারণ হিসেবে বলা আছে, “বোধশক্তির দুর্বলতা, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা ও পরিস্থিতিকে আয়ত্তে রাখিবার ক্ষমতার অভাবের জন্যই নারীদের সাক্ষ্য প্রম হইতেই গ্রহণযোগ্য নহে” (দ্য পেনাল ল’ অব্ ইসলাম ৪৪ ও ৪৫ পৃষ্ঠা)।

কিন্তু ওগুলো বাহানা ছাড়া আর কিছুই নয়। দেশে দেশে এমন কোন কাজ নেই যা নারীরা পুরুষের মতোই করছেন না, বরং অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা পুরুষের চেয়ে ভাল করছেন। এর সাথে এ-আইনও আছে − “হুদুদ মামলায় নারী বিচারক হতে পারবে না” (বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ২য় খণ্ড পৃঃ ২১৭, ধারা ৫৫৪)। এ-জন্যই ইরাণে সব নারী-বিচারককে কোর্টের কেরানি বানানো হয়েছে। যিনি জাতির গর্ব হতে পারতেন নোবেল প্রাইজ প্রাপ্ত সেই নারী-বিচারক শিরিণ এবাদী তাঁদের একজন, তিনি পদত্যাগ করেছেন।

মনে করুন কোন মা-বোনের চোখের সামনে খুন বা ডাকাতি হল, সেখানে আর কেউ নেই। শারিয়া-আদালতে মামলা গেল, মা-বোন সাক্ষী দিতে গেলেন। কিন্তু শারিয়ায় তাঁদের চাক্ষুষ সাক্ষ্য নেয়া হবে না। কারণ আইনটা হল − “খুনীর অপরাধ প্রমাণের জন্য কমপক্ষে দুইজন পুরুষ সাক্ষীর প্রয়োজন হইবে” (ধারা ৫৯৩, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৮৬ বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ), এআইনে ক সমর্থন করার জন্য সুরা বাকারা ২৮২ আর সুরা ত্বালাক আয়াত ২-এর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোরাণ খুলে দেখুন ওখানে খুনের কোন কথাই নেই। বাকারা বলছে ধার-দেনার দলিলে আর ত্বালাকে আছে বৌ-তালাকে দু’জন পুরুষ সাক্ষী রাখতে। শারিয়ায় এক হাদিসের সূত্রে এ-ও বলা আছে, দু’জন পুরুষের চাক্ষুষ সাক্ষ্য না থাকলে “বিচারক খুনীকে কায়েদমুক্ত করিয়া দিবেন” (ঐ পৃষ্ঠা ২৮৭), অথবা, চাক্ষুষ সাক্ষ্য না থাকলে শুধু আলামতের ভিত্তিতে খুনী-ডাকাতের শাস্তি হবে না (“ঐ” ধারা ৬০০-এর বিশেষণ, ২য় খণ্ড পৃঃ ২৯২), অথচ খুনের চাক্ষুষ সাক্ষী পাওয়া কঠিন, পারিপার্শ্বিক আলামতের ভিত্তিতে বহু খুনীর শাস্তি হয়। তাই আমরা বারবার বলছি এই আইনগুলো বদলানো দরকার। আশ্চর্য এই যে, শারিয়া বইতেও বলা হয়েছে আইনগুলো বদলানোর সুযোগ আছে (“ঐ” পৃঃ ২৬৭, ধারা ৫৭৬) কিন্তু বদলানো তো হয়ই নি বরং না বদলিয়েই এই আইন তাঁরা দেশে চালাতে চান। এটা শারিয়াপন্থীদের ১৪০০ বছরের পুরনো কৌশল। মুখে বলা হবে “পরিবর্তনের সুযোগ আছে” কিন্তু সে পরিবর্তন কোনদিনই করা হবে না।

এ-আইন ইসলাম-বিরোধী এটা শারিয়াবিদরাও বোঝেন। তাই আইনটাকে একটু মেরামত করার চেষ্টা হয়েছে যেমন, যেনা প্রমাণের ক্ষেত্রে চারজন ন্যায়পরায়ণ মুসলমান পুরুষ সাক্ষী লাগবে, অথবা প্রতিজন পুরুষের পরিবর্তে দু’জন মুসলিম ন্যায়পরায়ণ মহিলা হলেও চলবে (“ঐ” ৩য় খণ্ডের ৮৮৮ পৃষ্ঠা), অর্থাৎ রোকেয়া হলে বা শামসুনড়বাহার হলে সাতজন মেয়েদের সামনে যদি জ্বেনা হয় তবে অপরাধীরা সবার সামনে অট্টহাসি হাসতে হাসতে পগার পার হয়ে যাবে। আর “ন্যায়পরায়ণ মহিলা” কে, তা নিয়ে উকিলের তর্কবিতর্কের শেষ হবে না।

আমি ইসলামের কথা বলছি। আমি ন্যায়ের ও মানবতার কথা বলছি।

শারিয়ার একটা মারাত্মক আইন হল ধর্ষণের সাক্ষী। এ-আইনে অবৈধ সম্পর্ক এবং ধর্ষণ এ-দু’টোকেই প্রমাণ করতে লাগবে অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি অথবা চারজন বয়স্ক পুরুষ মুসলিমের চাক্ষুষ সাক্ষ্য (পাকিস্তানে শারিয়া আইনের ১৯৭৯-এর অর্ডিন্যান্স নম্বর ৭, ১৯৮০ সালের এর অর্ডিন্যান্স নম্বর ২০ দ্বারা সংশোধিত), এই আইন নিয়ে বহু সেমিনার, কন্ফারেন্স, বহু নিবন্ধ হয়েছে, এর পালায় পড়ে পাকিস্তানে হাজারো মা-বোন বহু বছর ধরে জেলখানায় বন্দি আছেন কারণ তাঁরা ধর্ষণের চারজন চাক্ষুষ সাক্ষী আদালতে হাজির করাতে পারেননি। মাত্র ২০০৬ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেণ্ট মুশাররফ এক হাজার নারীকে মুক্তি দিয়েছেন (‘ভোরের কাগজ’ ৯ জুলাই ২০০৬), এত বছরের জেলের ফলে এই হতভাগিনীদের জীবন ধ্বংস হল, এর জন্য দায়ী এই শারিয়া আইন। আরো দেখুন ‘দৈনিক স্টার, ৭ই জুলাই ২০০৩ – কল্যাণপুরে মা’কে বেঁধে কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণের একমাত্র সাক্ষী হল মেয়ের মা, ধর্ষক হল স্থানীয় তিন লোক। এখন এই মামলা যদি শারিয়া কোর্টে ওঠে তবে শারিয়ার আইন অনুযায়ী এক নারীর সাক্ষ্যে ধর্ষকদের শাস্তি দেয়া সম্ভব নয়। গ্রামের নির্জন ধানক্ষেতে ধর্ষিতা অভাগিনীদের একলা সাক্ষ্যেও সম্ভব নয়। এ-ধরনের আরো বহু ঘটনা আমাদের দলিলে আছে। কোনো কোনো দেশে এ-আইন বদলানো হয়েছে, পাকিস্তানে এখনো হয়নি।

এবারে আসা যাক কোরাণ-হাদিসে।

নিসা-র ১৫ নম্বর আয়াত : − “ব্যাভিচারিণী নারীদের বিরুদ্ধে চারজন পুরুষকে সাক্ষী হিসাবে তলব কর।” কারণ হল − “এ শর্ত আরোপের কারণ, যাতে স্ত্রীর স্বামী, তার জননী অন্য স্ত্রী অথবা ভাই-বোন ব্যক্তিগত জীঘাংসার বশবর্তী হয়ে অহেতুক অপবাদ আরোপ করার সুযোগ না পায় অথবা অন্য অমঙ্গলকারী লোকেরা শত্র“তা-বশত অপবাদ আরোপ করতে সাহসী না হয়” (মওলানার মুহিউদ্দিনের বাংলা কোরাণের তফসির পৃঃ ২৩৯)।

পরের প্রমাণ আরও অকাট্য। দেখুন সুরা নূর আয়াত ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত। পঞ্চম হিজরিতে এক যুদ্ধ শেষে নবীজীর কাফেলা ফিরতি-পথে মদিনার কাছেই রাত্রি যাপনের জন্য থেমেছিল। তারপরে রওনা হবার সময় বিবি আয়েশা প্রাকৃতিক কারণে দূরে গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে এসে দেখেন তাঁ র গলার হারটি নেই। তিনি সেটা খুজঁ তে যাবার পর লোকেরা পালকির ভেতরে তিনি আছেন মনে করে পালকিটা উটের পিঠে চড়িয়ে রওনা হয়ে যায়। এ-দিকে তিনি হারটি পেয়ে ফিরে এসে কাফেলা না দেখে সেখানে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েন এবং সারারাত ঘুমিয়ে থাকেন। সেকালে প্রতিটি কাফেলার কিছুটা পিছনে একজন লোক হেঁটে আসার রেওয়াজ ছিল, যাতে কিছু খোয়া গেলে তা পাওয়া যায়। এ- ক্ষেত্রে ছিলেন সাফওয়ান। তিনি পৌঁছলে বিবি আয়েশা সাফওয়ানের উটে চড়ে কাফেলার কাছে পৌঁছান। লম্বা সময় সাফওয়ানের সাথে একা ছিলেন বলে তখন সমাজে বিবি আয়েশার চরিত্র নিয়ে কানাঘুষা ও অপবাদ শুরু হয়। বিবি আয়েশা রাগে-দুঃখে বাপের বাড়ি চলে যান। মাসখানেক পর নবীজী তাঁর বাসায় এলে বিবি আয়েশা এবং তাঁর বাবা-মা এই তিনজনের সামনে সুরা নূরের ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত দশটা আয়াত নাজিল হয়। বিবি আয়েশা বলছেন : − “আলাহ আমার নির্দোষিতা প্রমাণের জন্যই কোরাণের ওই আয়াতগুলি নাজিল করিয়াছেন” (সহি বোখারি ৫ম খণ্ড পৃঃ ৩১৯ থেকে ৩২৯, হাদিস নম্বর ৪৬২, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসিন খানের বোখারির অনুবাদ)।

তাহলে আমরা দেখলাম আয়াতগুলো এসেছিল নারীদেরকে পুরুষের হিংস্র ছোবল থেকে বাঁচানোর রক্ষাকবচ হিসেবে। বউগুলোকে চরিত্রহীনতার মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আগে বেশ ঝেড়ে ফেলে পার পাওয়া যেত, এখন আনতে হবে চার-চারজন পুরুষ সাক্ষী। না হলে শাস্তি। অথচ নারী-রক্ষার সেই আয়াতের নামে নারী-বিরোধী আইন বানিয়ে চিরকালের জন্য মা-বোনের চাক্ষুষ সাক্ষ্যকে নির্লজ্জভাবে কি করে অস্বীকার করব আমরা ? এ-জন্যই বুঝি ডঃ ত্বাহা আল্ আলওয়ানী উদ্বিগড়ব হয়ে বলেছেন : “সামর্থ্য, ভুলিয়া যাইবার সম্ভাবনা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, সত্যভাষণ বা মিথ্যা বলার ক্ষেত্রে নারীপুরুষের ষর কোনই ভেদাভেদ নাই। কোরাণে এমন কিছুই নাই যা দিয়া ওইরকম ধরা যাইতে পারে। সুতরাং, নরনারীর সাম্য ছাড়া অন্য কিছু বলিবার কোন যুক্তিই নাই”

http://www.crescentlife.com/thisthat/feminist%20muslims/testimony_of_women_islamic_law.htm

কে এই ডঃ ত্বাহা আল্ আলওয়ানী ? রাস্তার লোক ? মোটেই নয়। শখের ইসলামি পড়–য়া ? মোটেই নয়। স্বঘোষিত ইসলামি বিশেষজ্ঞ ? মোটেই নয়। তিনি পৃথিবীর সর্বোচ্চ মুসলিম-সংস্থা ও-আই-সি (দি অর্গানাইজেশন অব্ দি ইসলামিক কনফারেন্স)-এর ফিকাহ্ অ্যাকাডেমীর সদস্য, আমেরিকা-ক্যানাডা ফিকাহ্ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, এবং হেনডন ভার্জিনিয়ার স্কুল অব্ ইসলামিক অ্যাণ্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস্-এর প্রেসিডেণ্ট।

এ-জন্যই বুঝি নবীজী উদ্বিগড়ব হয়ে বলেছেন − “আমার অনুসারীদের জন্য আমার সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা পথভ্রষ্টকারী ইমামগণ নিয়ে” − সহি ইবনে মাজাহ ৫ম খণ্ড হাদিস ৩৯৫২, অতঃপর, একজন বিবেকবান মুসলমান হিসেবে আর কোন্ কোন্ প্রমাণ তুমি অস্বীকার করিবে ?