shariakibole.com

শারিয়া ইসলাম

রাজনৈতিক ইসলাম বা শারিয়া-ইসলামে বিশ্বাসীরা শারিয়া-ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং এটাকে ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মনে করেন। এঁরা রাষ্ট্র বানিয়ে দুনিয়ার সব মুসলমানের ওপরে নিজেদের ব্যাখ্যা চাপিয়ে দিতে চান এবং সেই ব্যাখ্যার বাইরে সবাইকে অমুসলমান বলেন। প্রমাণ হল ঃ − “এই সভ্যতা-সংস্কৃতির মূলনীতির উপর (অর্থাৎ ইসলাম সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যার ওপরে − লেখক) যাহারা ইমান রাখে শুধু তাহাদিগকে বলে মুসলমান” (মওলানা মওদুদি, ১৯৩৮ সালে বানানো দারুল ইসলাম-এর গঠনতন্ত্র)। এ-কারণেই বাংলাদেশ জামাতে ইসলামির নেতা মতিউর রহমান নিজামী দাবী করতে পেরেছেন যে জামাতের বিরুদ্ধে কথা বলা নাকি খোদ ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র (দ্য ডেইলি স্টার, ১লা এপ্রিল ২০০৫)। এটা একটা সাঙ্ঘাতিক ইসলাম-বিরোধী অপরাধ। ইসলামের মালিকানা হাতানোর এই অপচেষ্টা চোদ্দশ’ বছরের পুরোন এবং সরাসরি কোরাণ-বিরোধী। আমি মওলানা মওদুদির ব্যক্তিগত সমালোচনা করব না কিন্তু শারিয়া-ইসলাম বুঝতে হলে তাঁর ব্যাখ্যাগুলো দেখতেই হবে। কারণ ১৯২২-১৯২৮ সালে মিশরের হাসান বানড়বা ও তার পরে সায়িদ কুতুবের পর আধুনিক কালে তিনিই প্রম শারিয়া-ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্রের তত্ত্বকে দৃশ্যগ্রাহ্য ও আপাত গ্রহণযোগ্য কাঠামো দান করেন। সেই রাষ্ট্রের রূপরেখা বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন আমার বাংলা ওয়েব সাইট ইধহমষধৎওংষধস.পড়স ; এখানে সংক্ষেপে বলছি তাঁর (১) জিহাদ ইন ইসলাম, (২) হিউম্যান রাইট্স্ ইন ইসলাম, (৩) ইসলামিক ল’ অ্যাণ্ড কন্স্টিটিউশন, (৪) এ শর্ট হিস্ট্রি অফ দ্য রিভাইভালিস্ট মুভমেণ্ট ইন ইসলাম, (৫) দ্য প্রসেস অফ ইসলামি রেভল্যুশন, (৬) দি ইসলামিক মুভমেণ্ট, (৭) ডায়নামিক্স অফ ভ্যালুজ্, পাওয়ার অ্যাণ্ড চেঞ্জ, (৮) কল্ টু জিহাদ, (৯) মে ১০, ১৯৪৭ তারিখে পাঠানকোটে দেয়া বক্তৃতা ইত্যাদির বিভিনড়ব পৃষ্ঠা থেকে। এগুলো বিচ্ছিনড়ব উদ্ধৃতি নয়, এই কথাগুলোতে ফুটে উঠেছে শারিয়া-ইসলামের মূল চেহারা, চরিত্র ও পরিকল্পনা।

“ইসলামি নয় এমন সরকারের কর্তৃত্বের আওতায় মুসলমানের পক্ষে ইসলামি জীবন যাপন অসম্ভব … একজন মুসলমান যতক্ষণ মুক্ত থাকে ততক্ষণই ইসলামি জীবন যাপন করিতে পারে। প্রমেই একটি সার্বভৌম ইসলামি রাষ্ট্র প্রয়োজন, যাহাতে তাহারা ইসলামি আইন প্রয়োগ ও নিজেদের জীবনকে স্রষ্টার আদেশ অনুযায়ী পালন করিতে পারে … যদিও ইসলামি রাষ্ট্র পৃথিবীর যে কোন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা যাইতে পারে, কিন্তু মানবাধিকার ও সুবিধাগুলিকে ইসলাম শুধু ইহার সীমানার ভিতরেই সীমাবদ্ধ রাখিতে রাজি নহে , ‘পার্টি’ শব্দটার জন্য কোরাণ যে শব্দ ব্যবহার করিয়াছে তাহা হইল ‘উম্মা’ … জামাত আসলে কোন মিশনারী নহে, ইহা হইল আলার কাজ করার ‘পার্টি’ … ইসলাম দেশ-জাতি নির্বিশেষে ইসলামের দর্শন ও কর্মপদ্ধতির পরিপন্থী সকল রাষ্ট্র ও সরকারকে পৃথিবী হইতে ধ্বংস করিতে চায় … মুসলিম পার্টি অবশ্যই অন্য দেশের লোকদের প্রতি ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানাইবে। ইহা ছাড়াও যদি মুসলিম পার্টির হাতে যথেষ্ট শক্তি থাকে তবে সে (দুনিয়ার) অমুসলিম সরকারগুলিকে উচ্ছেদ করিবে এবং সেস্থলে ইসলামি সরকার স্থাপন করিবে … নবীজী ইসলাম গ্রহণের জন্য আশেপাশের দেশগুলিতে আমন্ত্রণ পাঠান। যখন ওই দেশগুলির শাসকগণ এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিল, নবীজী তখন তাহাদের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণের ব্যবস্থা করিলেন … ইসলামি জিহাদ রাষ্ট্র-পরিচালনায় অমুসলিমদের অধিকারকে স্বীকার করে না … এই লোকগুলি (অর্থাৎ শারিয়াপন্থীরা) যাহারা ধর্মের বিস্তারকারী, তাহারা ধর্ম-প্রচারকারী বা মিশনারি নহে। তাহারা বরং আলাহ্ ’র কার্যনির্বাহী (functionaries) । তাহাদের দায়িত্ব হইল শক্তির দ্বারা দুনিয়া হইতে অত্যাচার, নষ্টামি, সঙ্ঘর্ষ, অনৈতিকতা, স্বৈরাচারী এবং শোষণ উচ্ছেদ করা … রাজনৈতিক দর্শনের দৃষ্টিতে ইসলাম (ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্র theocracy হিসেবে) ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিরোধী তত্ত্ব … জিম্মিরা (অমুসলিম নাগরিকরা) দেশরক্ষা বাহিনীতে যোগ দিতে পারিবে না … ইসলামি সরকারে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের বিশেষ কোন জায়গা নাই … নাচ, গান এবং চিত্রাঙ্কন চরম অনৈসলামিক ও কুৎসিত শিল্প … শাহ্ ওয়ালিউলাহ বলিয়াছেন যে পরিস্থিতি চাহিলে তিনি অস্ত্র দ্বারা সমাজ পরিবর্তন করিবেন … মানুষ যে একটি স্বাধীন সত্ত্বা এবং তাহার ইচ্ছা এবং চিন্তাশক্তি অনুযায়ী স্বাধীনভাবে চলিতে সক্ষম, ইহা মূর্খের অভিমত মাত্র … এই লক্ষ্য (সামাজিক মূল্যবোধ) ততদিন অর্জিত হইবে না যতদিন সমাজের ক্ষমতা অবিশ্বাসী শাসকের হাতে থাকিবে, অথবা যতদিন ইসলামের অনুসারীরা আরাধনার আনুষ্ঠানিকতায় আবদ্ধ থাকিবেন যেইগুলি ওই (অবিশ্বাসী) শাসকদের ইচ্ছামাফিক অনুমোদন ও সমর্থনের উপর নির্ভরশীল … ন্যায়পরায়ণ লোকের হাতে (রাষ্ট্র) ক্ষমতা অর্জন এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এই কর্তব্যে অবহেলা করিয়া আলাহ্ে ক সন্তুষ্ট করার কোনই উপায় নাই … তিন-তাগুত (বাতিল) হইল (১) ধর্মনিরপেক্ষতা, কারণ উহা ধর্মহীনতা, (২) আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ, এবং (৩) (পশ্চিমা) গণতন্ত্র − পরের দুইটি র্শিক্ … এই সরকারের কার্যপ্রণালী এমন যে ইহাতে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের বিশেষ অবকাশ নাই … রাজনৈতিক দর্শনের দৃষ্টিতে ইসলাম পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী। ইসলামে পশ্চিমা গণতন্ত্রের লেশমাত্র নাই …” ইত্যাদি।

অনেক ইসলামি দার্শনিকের চোখে তাঁর দর্শনের ভিত্তিহীনতা, অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, অমানবিকতা এবং ভবিষ্যতের ভয়াবহ সর্বনাশা কুফল ঠিকই ধরা পড়েছিল। আধ্যাত্মিকতার সাথে রাজনীতির মিশ্রণে এ ক্ষতি যে শুধু মুসলমানদেরই নয় বরং সমস্ত মানবজাতির, সেটাও তাঁরা বুঝেছিলেন এবং তাঁরা সেটা বলেছিলেনও। সে কথাগুলো জনগণের কানে পৌঁছায়নি তার একটা প্রধান কারণ হল তাঁদের কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না। এদিকে মওলানা মওদুদি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে ১৯৪১ সালে জামায়াত-এ ইসলামি প্রতিষ্ঠা করেন। সৌদি বাদশাহ তাঁকে এক বিশেষ পুরস্কারে পুরস্কৃত করেন। এতে তাঁর অনেক অনুসারী ক্ষুব্ধ হন এজন্যে যে, রাজত্ব ইসলামে নিষেধ হবার পরও নবীজীর খেলাফকারীর হাত থেকে মওদুদি কি করে এ পুরস্কার নিলেন। আসলে শারিয়া-ইসলাম সৌদি রাজত্বকে শক্তিশালী করে বলে সৌদি বাদশাহেরা শারিয়া-ইসলামে অজস্র টাকা ঢেলেছে। ফলে বিশ্বে শারিয়া- ইসলাম বিভিনড়ব নামে ও চেহারায় বহুগুণে বেড়ে উঠেছে। আজ এই এত বছর পরেও শারিয়া-ইসলামকে ইসলামি দর্শনের ভিত্তিতে প্রতিহত করার তেমন কোন সংগঠন নেই। অথচ যে কোন দর্শনের অগ্রগতিতে পাল্টা, বিপ্রতীপ এবং সমান্তরাল সংগঠন দু’দলের জন্যই দরকার। এতে সবারই ভুল-ভ্রান্তি ধরা পড়ে এবং সার্বিক অগ্রগতিতে মানবসমাজের সুবিধে হয়। সে বিরোধিতার বাস্তব সুবিধে শারিয়া- ইসলাম বিশেষ পায়নি বা নেয়নি কোনদিনই।

ইসলামি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা কিভাবে হবে, এবং তারপর কেউ মনে মনে মুরতাদ হয়ে গেলে ইসলামি রাষ্ট্রের কি হাল হবে এ নিয়ে মওদুদি মহা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি এই উদ্ভট ও হিংস্র সমাধান দিয়েছেন ঃ “ইসলামি বিপে বর পর জনগণকে নোটিস দেওয়া হইবে যাহারা বিশ্বাসে-কর্মে ইসলাম ছাড়িয়াছে ও সেভাবেই থাকিতে চায় তাহারা প্রকাশ্যে অমুসলিম পরিচিতি প্রকাশ করিয়া এক বছরের মধ্যে দেশত্যাগ করুক। তারপর যাহারা জন্মাইবে তাহারা হইবে মুসলিম। ইসলামি আইন প্রয়োগ করিয়া তাহাদিগকে ধর্মীয় কাজকর্ম ও দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা হইবে। তারপর কেউ ইসলাম ছাড়িয়া দিলে তাহাকে খুন করা হইবে” (দ্য পানিশমেণ্ট অব্ দি অ্যাপোস্টেট অ্যাকর্ডিং টু ইসলামিক ল’)। এখন আপনারাই বলুন, কত উদগ্র ও নিষ্ঠুর হলে মানুষের ওপর এই ভয়াবহ অত্যাচারের প্রস্তাব করতে পারে কোনো নেতা ! কোটি কোটি লোক বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে ঘরবাড়ি ব্যবসাপাতে ছেড়ে বৌ-বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাবে ? কেন যাবে ? কোন্দে শ তাদের রেসিডেন্সী ভিসা দেবে ? কেনই বা দেবে ? এই হিংস্র অত্যাচারের দায়িত্ব শারিয়াপন্থীরা নেবেন ? এঁদের উদ্দেশ্য করেই কি কোরাণ-রসুল আদেশ দিয়েছেন ⎯ ধর্মে বাড়াবাড়ি করো না ? (নিসা ১৭১, মায়েদা ৭৭ ও বিদায় হজ্বের
ভাষণ) ॥