মো টেই নয়। কোরাণে শারিয়া শব্দের অর্থ হল মূল্যবোধ। মূল্যবোধ কি কখনো অচল হয় ? “পিতা-মাতাকে ভক্তি করিও” কিংবা “সুবিচার কর, এটাই আলাহ’র অধিক নিকটবর্তী” (সুরা মায়েদা ৮), এ-কথা কি অচল হয় কখনো ? হয় না, বরং ওটাই মানুষকে মানুষ বানায়। কিন্তু এক দেশে এক যুগের এক সমাজের অনেক আইন অন্য দেশে অন্য যুগের অন্য সমাজে অচল হবেই। সেজন্যই বুঝি বাস্তববাদী ইমাম তাইমিয়া বলেছিলেন ঃ “মুসলিম-বিশ্বে একটি চিরন্তন আইনব্যবস্থা বাস্তবভিত্তিকও নয়, সম্ভবও নয়” (“দ্য পলিটিক্যাল থট অফ ইবনে তাইমিয়া, পৃঃ ১০৬ − প্রফেসর কামরুদ্দীন খান − আদম প্রকাশনী, দিলী)। অবস্থার পরিবর্তনের সাথে বিধানের পরিবর্তন হতেই হবে। এ-পরিবর্তনের স্বীকৃতি দেয়া আছে খোদ কোরাণেই ঃ “আমি কোন আয়াত রহিত করিলে কিংবা ভুলাইয়া দিলে তাহা অপেক্ষা উত্তম অথবা সমপর্যায়ের আয়াত আনি” (বাকারা ১০৬), “যখন আমি এক আয়াতের স্থলে অন্য আয়াত উপস্থিত করি এবং আলাহ যাহা অবতীর্ণ করেন তাহা তিনিই ভাল জানেন” (নাহ্ল ১০১)। একে বলে নস্খ্।
বিশেষজ্ঞ বলছেন ঃ “নস্খ্-এর উপলব্ধি আসিয়াছে মানুষের উপকারের জন্য সমাজের বিদ্যমান পটভূমি ও আইনের সমন্বয় করার প্রয়োজন হইতেই” (প্রিন্সিপল্স্ অব্ ইসলামিক জুরি¯প্র“ডেন্স − ডঃ হাশিম কামালি, পৃঃ ২০৩)। তিনি এ-ও বলেছেন ঃ “কোরাণ ধীরে ধীরে ক্রমাগত ২৩ বছর ধরিয়া নাজিল হইয়াছিল, এ-সত্য ইহাই প্রমাণ করে যে কোরাণ সেই সময়ের পরিবর্তনগুলিকে গণনায় ধরিয়াছিল” পৃষ্ঠা ৫০৪। ঠিকই তো, নাহলে তো কোরাণ একদিনেই নাজিল হতে পারত। সমাজের বর্তমান পরিস্থিতিকে গণনায় ধরতেই হবে এটা কোরাণেরই নির্দেশ। আইন বানাবার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি বলেই আজ মুসলিম সমাজে বহু বিপর্যয়। আমাদের দিব্যদৃষ্ট বাউলও কি সুন্দর গেয়ে গেছেন ঃ “দেশ সমস্যা অনুসারে, ভিনড়ব বিধান হতে পারে” (লালন শাহ্)। ২০০৩ সালে পাকিস্তানের সরকারি কমিটিও রিপোর্টে বলেছে “ইহা অতি পুরানো কাপড়ের মত। ইহাকে সোজা করিতে গেলে ছিঁড়িয়া যাইবে” (পাকিস্তানের জাতীয় কমিশন রিপোর্ট)। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত শারিয়া-সমর্থক বিশেষজ্ঞের দলও পইপই করে বিশ্ব- মুসলিমকে সাবধান করে বলেছেন শারিয়ায় মহা সমস্যা আছে, সেগুলো ঠিক না করা পর্যন্ত যেন শারিয়া আইন প্রয়োগ করা না হয়। উদ্ধৃতির সারাংশ দিচ্ছি তাঁদের বই থেকেই।
“শারিয়াকে এ-যুগে চালাইতে হইলে অবশ্যই যে প্রচণ্ড ঘষামাজা করিতে হইবে সে-ব্যাপারে আমি সবাইকে স্মরণ করাইয়া দিতেছি…সেই যুগে যে উদ্দেশ্যে শারিয়ার উসুল বানানো হইয়াছিল, অনেক কারণেই এখন উহা সেই উদ্দেশ্য অর্জন করিতে সক্ষম নহে…শারিয়ার উসুল নিজের পদ্ধতি ও তত্ত্বের ভেতর সমাজের স্থান- কালের ব্যাপারকে ঠিকমত অন্তর্ভুক্ত করে নাই” (প্রিন্সিপল্স্ অব্ ইসলামিক জুরি¯প্র“ডেন্স − ডঃ হাশিম কামালি, পৃঃ ১৩, ৫০০, ৫০৪)। “শারিয়ায় সেই সমাজ প্রতিফলিত যে-সমাজে শারিয়া গড়িয়া উঠিয়াছিল…বর্তমান মানুষের বাস্তব প্রয়োজন মিটাইতে পারে নাই…শাফি’র পরে শারিয়া ধীরে ধীরে মানুষের প্রয়োজন হইতে বিচ্ছিনড়ব হইয়া পড়ে” (ইমাম শফি’র রিসালা, পৃঃ ১, ৩ ও ৩৪৪)।
“কোরাণের বিধানগুলো হইতে বোঝা যায় যে, বিধানগুলো নাজিল হইয়াছিল যখন কোন সামাজিক, নৈতিক বা ধর্মীয় দরকার হইয়াছিল, কিংবা যখন সাহাবীরা নবীজীর সাথে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করিয়াছেন” (শারিয়া দি ইসলামিক ল’ − ডঃ আবদুর রহমান ডোই, পৃঃ ৭)। বলা বাহুল্য, এ-ধরনের উদাহরণ আছে মাত্র কয়েকটা, যা দিয়ে একটা দেশ চলতে পারে না।
“সমস্যা তখনই হয় যখন (শারিয়ার) অতীতের প্রয়োজনকে এখনকার রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় প্রয়োগ করা হয়” (দি ইসলামিক রুট্স্ অব্ ডেমোμμ্যাটিক পুরালিজ্ম্ , পৃঃ ৫৭) − ডঃ আবদুল আজিজ সাচেদিনা, বিশ্বের সর্বোচ্চ ইসলামি
বিশেষজ্ঞদের একজন, অতীতে বর্তমানে এঁদের কথার সত্যতা প্রমাণ হয়েছে অসংখ্য
বাস্তব ঘটনার মধ্য দিয়ে।
“সমাজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করিয়া সঙ্কীর্ণ মনের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কোরাণের আয়াতকে ব্যবহার করাও ইসলামি নহে” (হিউম্যান রাইট্স্ ইন্ দ্য মুসলিম ওয়ার্লড − ডঃ মায়মুল আহসান খান, পৃঃ ৫৮)।
যে কোনো সমাজবিজ্ঞানীর গবেষণায় সমাজের পরিস্থিতির কথাটা বারবার ফিরে আসে। মওলানা মুহিউদ্দিনের বাংলা কোরাণের ৩৩৪ পৃষ্ঠায় বিস্তারিত বলা আছে, সমাজ পরিবর্তনের সাথে “শাখাগত বিধিবিধান পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে।” আসলে শারিয়া ও আচার-অনুষ্ঠান দু’টোই বিবর্তিত হচ্ছে। শুরুতে জাকাত ছিল রাষ্ট্রের পাওনা, এখন সেটা গরিবদের। হজ্বের সময় পাথর মারার পদ্ধতি বদলে গেছে সম্প্রতি। রক্তমূল্যের পরিমাণ নবীজী যা ধার্য করেছিলেন তা এখন আর নেই। মাবিয়া মক্কা-মদীনায় এসে বলেছিল − “নবীজীর সময়ের অনেক কিছু এখন আর চলে না,” মুসলমানরা তা মেনেও নিয়েছিল। (হজরত ওসমানের সময়) মুসলমানেরা জামাতে নামাজ পড়া ছাড়া অনেক ভাল কাজ করা ছেড়ে দিয়েছে − বোখারি ১ম খণ্ড হাদিস ৬২২। তামাত্তু হজ্বের পদ্ধতিও বদলে গেছে তখনই (বোখারি ২য় খণ্ড হাদিস ৬৩৪)। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শারিয়া-নেতা মুহম্মদ আবদুহ্ এখন শারিয়ার অনেক আইন বদলাবার প্রস্তাব করেছেন। এমনকি সম্প্রতি সোমালিয়ার বিজয়ী সামরিক নেতা ও ইমাম স্পষ্টই বলেছেন শারিয়ার আইন বদলানো হবে (টাইম অন্লা ইন ২২ নভেম্বর, ২০০৬)। অপরাধের বিবর্তন হয় বলে শাস্তিরও বিবর্তন হতে হবে, নাহলে অপরাধীরা শাস্তি পাবে না। ভেবে দেখুন, আগের আমলের চুরি আর এখনকার চুরি কি এক জিনিস ? যারা আজ ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা ধার নিয়ে কখনোই শোধ দেয় না, কিংবা যে শেয়ার-ব্যবসায়ী কোলকাতায় বসে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিল, তারা কি চোর ? না হলে, কেন নয় ? চোর হলে তাদের কি হাত কাটার শাস্তি হবে ? না হলে, কেন হবে না ?
এগুলো গুরুতর প্রশড়ব। কাজেই সামাজিক বিবর্তনকে উপেক্ষা করা যায় না, কোরাণ-রসুল তা করেনও নি। এমনকি মওদুদিও সে কথা বলেছেন। মুসলিম খলীফারা তাঁদের মন্ত্রীদেরকে নিজেরাই মনোনীত করতেন, মন্ত্রীরা কেউ জনগণের নির্বাচিত হতো না। মওদুদির সময়ে এ-পদ্ধতির বিরুদ্ধে সমালোচনা হলে তিনি সে সমালোচনাকে পাত্তা দেননি এই বলে ঃ “তৎকালীন বিদ্যমান পরিস্থিতি উপেক্ষা করিয়া ঐ সময়ের ঘটনাকে বর্তমানের আলোকে দেখিবার জন্যই এই ভুল হইয়াছে” (ইসলামিক ল’ অ্যাণ্ড কন্সটিটিউশন, পৃঃ ২৩৬)। মওদুদির কথাটা সত্যি, অথচ সেই মওদুদিই শারিয়া সমর্থন করতে গিয়ে চরমভাবে কোরাণ-সুনড়বতের “তৎকালীন বিদ্যমান পরিস্থিতি” উপেক্ষা করেছেন। তাঁর প্রচণ্ড আতঙ্ক ছিল, জনগণ যদি টের পায় শারিয়ায় একটা হলেও কোরাণ-বিরোধী আইন আছে তবে তারা শারিয়ায় অন্যান্য কোরাণ-বিরোধী ও মানবতা-বিরোধী আইন খুঁজে বের করে ফেলবে। তাতে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ-কথা তিনি বলেছেনও তাঁর “ইসলামি আইনে মুরতাদের সাজা” বইতে।
আসলে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে হজরত ওমরের কাছ থেকে। এমনকি, “হজরত ওমর বাকী সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে হাদিস ২০৩কে বলবৎ করেন ও হাদিস ২০৪, ২০৫ ও ২০৬কে রহিত করেন” − আজিজুল হকের বোখারীর অনুবাদ ১ম খণ্ড পৃঃ ১৯৭-এ থাকার কথা)। তিনি দুর্ভিক্ষের সময় চোরের হাত কাটেননি এবং এক অসুমলিম গোত্রের কাছ থেকে জিজিয়া নেননি। তিনি কি তাহলে কোরাণ লঙ্ঘন করেছিলেন ? আক্ষরিক দিক দিয়ে করেছিলেনই তো, কারণ কোরাণে স্পষ্ট লেখা আছে চোরের হাত কেটে দিতে এবং অমুসলিম নাগরিকদের কাছ থেকে জিজিয়া কর নিতে। কিন্তু কোরাণের অক্ষর অতিক্রম করে তিনি বজায় রেখেছিলেন কোরাণের মর্মবাণী। বাস্তবের সাথে এই সামঞ্জস্য ইসলামের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। আইনে আমরা এটাই প্রতিফলিত দেখতে চাই। এটাই আমরা আশা করি আমাদের বর্তমান শারিয়াবিদদের কাছ থেকে। কাজটা হচ্ছেও, দেখুন ঃ
“পৃথিবীতে ফৌজদারি আইনের সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞদের একজন পেনসিলভেনিয়া ল’ স্কুলের প্রফেসর ডঃ পল এইচ. রবিনসন মালদ্বীপের জন্য নূতন আইনের খসড়া করিতেছেন।…যেহেতু গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মালদ্বীপ একটি ইসলামি রাষ্ট্র এবং আইনগতভাবে সকল নাগরিকই মুসলিম, তাই এই আইন হইবে পৃথিবীর প্র ম শারিয়া-ভিত্তিক আধুনিক ফৌজদারি আইন” (২৪ জুলাই − ২০০৫ frontagemag.com)। এমন অনেক উদাহরণ এ বইতে দেয়া আছে ॥