কথা উঠেছে ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে গিয়ে ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করা নিয়ে। কথাটা ধর্মীয় রাজনীতি বলা হলেও বিষয়টা ইসলামের নামে রাজনীতি, যাকে অনেকে মৌদুদিবাদও বলেন। সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও সংবিধানে বিসমিলাহ। আমরা জানি বাহাত্তরে অবৈধ হবার পরেও পঁচাত্তরের খিড়কি দরজা দিয়ে ধর্মীয় রাজনীতি আবার ফিরে এসেছে। সেই খিড়কি বন্ধ না ক’রে আমরা বাহাত্তরের প্রধান ফটক বন্ধ করবো কোন্ ভরসায় ? মৌদুদিবাদের কৌশল বিশেষণ করে পাল্টা কৌশল উদ্ভাবন না ক’রে রাজনৈতিক ঘাঁটাঘাঁটি করলে লাভ হবে না। তার প্রাথমিক কৌশল রাজনীতি-নিরপেক্ষ। সরকারে সে না থাকলেও, নির্বাচনে না জিতলেও, এমনকি সাংবিধানিকভাবে সে অবৈধ হলেও তার অসংখ্য মাদ্রাসা থেকে গত কয়েক দশকে অসংখ্য সমর্থক বেরিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রে, সামরিক বাহিনীতে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ও স্ট্রীটপাওয়ারে তাকে শক্তিশালী করেছে, ভবিষ্যতে আরো করবে। সাথে আছে অজস্র পেট্রোডলারে গড়া ইসলামী লেবেল লাগানো মৌদুদিবাদী সংগঠনগুলো, অজস্র বইপত্র ও দেশে কামানো অঢেল টাকার শক্তি। আরো সাথে আছে মধ্যপ্রাচ্য-প্রবাসী বাংলাদেশীরা (৩০ লক্ষ?) যাঁরা প্রায় সবাই মৌদুদিবাদে বিশ্বাসী। এঁরা আর্থিক প্রতিপত্তিতে এবং আরো বহু হাজার মাদ্রাসা গড়ে নিজেদের অঞ্চলকে সেই তত্ত্বে প্রভাবিত করেছেন। এসব শক্তিতে বহু বছর ধরে মৌদুদিবাদই আসল ইসলাম হিসেবে জাতির চোখের সামনে বড় করে ধরা আছে। কিন্তু তার মুখোশ খুলে ইসলামের শান্তিময় ব্যাখ্যা প্রচারের কোনো সংগঠন নেই বা থাকলেও দুর্বল।
তার কৌশলের ওপর বিস্তারিত লেখার সুযোগ এখানে নেই, কিন্তু বলা দরকার সে বড়ই সুদক্ষ খেলোয়াড়। আপাততঃ সে একটু কাদায় পড়লেও তাকে ছোট ক’রে দেখাটা আমাদের জন্য হবে মারাত্মক আত্মঘাতী। অন্যের ব্যর্থতার ফসল ঘরে তুলতে এবং অন্যের দ্বারা নিজের মতলব উদ্ধারে সে ওস্তাদ। দেশে বিএনপি’র ঘাড়ে চড়ে স্বার্থ উদ্ধার ছাড়াও পাকিস্তান শারিয়া-রাষ্ট্র হওয়া, আমাদের সংবিধানে “বিসমিলাহ” বা “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” যোগ করা এসব গণবিচ্ছিনড়ব সিদ্ধান্তও নির্বাচিত সাংসদরা আলাপ-আলোচনা বা বিতর্ক করে নেননি, নিয়েছে সামরিক স্বৈরশাসকরা। তুর্কিস্থানে কামাল পাশা, বাহাত্তরে শেখ মুজিব, ও মিসরের নাসের সাংবিধানিকভাবে তাকে নিষিদ্ধ করার পরেও ঐ প্রতিটি দেশে সে ফিরে এসেছে প্রবলতর শক্তিতে। মুসলিম বিশ্বের বৃহৎ অংশ গ্রাস করার পর এখন সে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনকে পুরোটাই, এবং ইউরোপের কিছুটা, নিয়ন্ত্রণ করছে। পশ্চিমা সিস্টেমের সাহায্যে সে কিছু নাদান পশ্চিমাদেরই সহায়তায় ক্রমাগত পশ্চিমা সিস্টেম ভাঙছে।তাছাড়া প্রাকৃতিক অনেক কারণেই আওয়ামী লীগ চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না, প্রতিপক্ষ একদিন ক্ষমতায় আসবেই। এসেই তারা তড়িৎ গতিতে আবার মৌদুদিবাদকে সাংবিধানিক বৈধতা দেবে। এটা ঠিক, জাতি একাত্তরের অভিজ্ঞতা ও মরমীয়া ইসলামের উপলব্ধি দিয়ে মৌদুদিবাদকে এখনো ঠেকিয়ে চলেছে। এটাও ঠিক, আমাদের সাংস্কৃতিক শক্তি, নূতন প্রজন্মের প্রবল আধুনিকায়ন ও উদীয়মান নারীশক্তিও তার প্রবল প্রতিপক্ষ। কিন্তু প্রধান প্রবেশদ্বার নিষিদ্ধ হলেও বিভিনড়ব কৌশলে খিড়কি দরজা ব্যবহারে সে অভিজ্ঞ ও দক্ষ। পাকিস্তানের মতো তার ধূর্ত কৌশলে ধীরে ধীরে ইসলামের শান্তিময় ব্যাখ্যায় ঘুণ ধরিয়ে ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
তার মনোবল ভেঙে দেবার জন্য তাকে সাংবিধানিকভাবে অবৈধ করাটা শর্ট-টার্ম টাস্ক হতে পারে, লং-টার্ম নয়। তার সমস্ত প্রতারণা ও হিংস্রতা যে উৎস থেকে ওঠে তা হলো তার অপদর্শন। সেই অপদর্শনের দলিল সম্বন্ধে গণসচেতনতাই তার ফিরে আসার পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে পারে। দরকার শুধু ইসলাম ও মৌদুদিবাদের দলিলগুলো থেকে জাতিকে দেখানো কিভাবে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে কোরাণ, রসুল, ন্যায়বিচার ও নারী অধিকারের সাথে, কোরাণ-রসুল ও ইসলামকে সে যতটা অপমান করেছে আর কেউ তা করেনি। যেমন, তার আইনে আছে তওবা করলে গণহত্যা, গণধর্ষণ, সম্পত্তি লুণ্ঠনকারীদের শাস্তি হবে না − বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড, ধারা ১৩। অর্থাৎ বাংলাদেশ শারিয়া-রাষ্ট্র হলে মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হবে না কারণ তারা “তওবা” করবে। আরেকটা উদাহরণ − শারিয়া আইন মোতাবেক শারিয়া-রাষ্ট্রে খুনজখম, চুরি, ডাকাতি, পরকীয়া ইত্যাদি অপরাধে সবার শাস্তি হবে কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানের শাস্তি হবে না (বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ৩য় খণ্ড, ধারা ৯১৪গ)। খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি, মদ্যপান, পরকীয়া মামলায় নারী-সাক্ষী অবৈধ (বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ১ম খণ্ড, ধারা ১৩৩ ও ২য় খণ্ড, ধারা ৫৭৬।
এ দলিলগুলো মৌদুদিবাদের মৃত্যুবাণ। কারণ এই শারিয়া কেতাব তাদেরই লেখা এবং বাংলাদেশ ইসলামী ফাউণ্ডেশনের প্রকাশিত। এরকম অজস্র দলিল আছে যা দেখালে যাঁরা অন্ধবিশ্বাসে তার ইসলাম-বিরোধী অপতত্ত্বের খপ্পরে পড়েছিলেন তাঁদের অন্ততঃ বড় একটা অংশ শুধু সরেই আসবেন না বরং তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। তেমন অনেককে আমি চিনি। এগুলো স্কুল-কলেজের সিলেবাসেও অন্তর্ভুক্ত করা দরকার যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্ম ইসলামী জ্ঞানের শক্তিতে তাকে উচ্ছেদ করতে পারে। ক’মাস আগে দেয়া আদালতের এ-পরামর্শ সরকারের গ্রহণ করা উচিত। তাতারস্থানে ইসলামি নেতৃত্ব জনগণকে মৌদুদিবাদের ভয়াবহতা শিখিয়েছেন, জনগণই মৌদুদিবাদের বিরুদ্ধে হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই একই বীজ আমাদের ইসলাম প্রচারকেরাও আমাদের আকাশে-বাতাসে মাটিতে-পানিতে দিয়ে গেছেন, বীজটাতে দলিলের মাধ্যমে গণসচেতনতার পানি ঢালা দরকার।
দু’টো গুরুত্বপূর্ণ প্রশেড়বর কোনই ব্যাখ্যা দেয়নি সরকার। (১) ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করার কারণ কি ? মুক্তিযুদ্ধে এক জামাতের হিংস্র কর্মকাণ্ডের কারণে বাকী সবার ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ হবার যুক্তি ধোপে টেকে কি ? (২) জামাতি ও জামাত-সমর্থক দৈনিকগুলো তারস্বরে যে যুক্তি দেখাচ্ছে, বহু দেশে এমনকি ভারত-ইউরোপ- আমেরিকাতে ধর্মীয় রাজনৈতিক দল আছে। বাংলাদেশে কেন নিষিদ্ধ হবে, এ দাবী ভিত্তিহীন কেন ?
বিষয়টা আসলে একাত্তরও নয়, জামাত বা মুক্তিযুদ্ধও নয়, এবং ইসলামও নয়। বিষয়টা হলো ধর্মের নামে রাজনীতি ক’রে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করাকে নিষিদ্ধ করা। রাষ্ট্রক্ষমতা হলো চূড়ান্ত ক্ষমতা। বহুজাতিক বহুমাত্রিক বহুধারণার বিশ্বে সেই চূড়ান্ত ক্ষমতা কোনো বিশেষ ধর্মের একমাত্রিক ধ্বজাধারীদের হাতে তুলে দেয়া যায় না। এই একমাত্রিকতার কারণেই ধর্মীয় রাষ্ট্রগুলো হাজার হাজার বছর সময় পাবার পরেও তাদের বৈধতা প্রমাণে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মব্যবসায়ীরা তদের স্রষ্টাকে তুষ্ট করতে যত সর্বগ্রাসীভাবে ও যত উলাে সর সাথে মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে ততটা আর কোনো কারণে করেনি − প্যাস্কেল। অতীতে হিন্দুরাষ্ট্রে নরবলিসতীদাহ সহ নারী ও অচ্ছুৎদের ওপরে এবং খ্রীষ্টান রাষ্ট্রে ডাইন পেড়ানো, দার্শনিক বিজ্ঞানীদের অত্যাচার-হত্যা ছাড়াও ইন্কুইজিশন অর্থাৎ ভিনড়বমতের ওপরে ভয়াবহ গণহত্যা ও অত্যাচার হয়েছে। সেজন্যই জনতা ভৈরব গর্জনে ধর্মীয় রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা বানিয়েছিল। কিন্তু ব্যতিক্রম বাদ দিলে মুসলিম- খেলাফতও বিশ-বাইশটি “আমিরুল মু’মেনীন” বংশের গৃহযুদ্ধ, বিদ্রোহ, পাল্টা বিদ্রোহ, গুপ্তহত্যা, সুফি ও দার্শনিক বিজ্ঞানীদের ওপরে অত্যাচার-হত্যা সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের রক্তে রক্তাক্ত। শেয়াল কুমিরকে তার বাচ্চা দেখানোর মতো ইসলাম-ব্যবসায়ীরা ঐ ব্যতিক্রমগুলোকেই বারবার জাতির সামনে তুলে ধরেন।
ধর্মীয় রাষ্ট্র বলতে বিশ্বে এখন শুধু কিছু শারিয়া-রাষ্ট্র আছে এবং তারাও মানবাধিকারের দিক দিয়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ক্রাইম হিসেবেই দেখে এবং শাস্তির ব্যবস্থা করে সেখানে ধর্মীয় রাষ্ট্র সেটাকে ধর্মের নামে বৈধ করে। হিন্দুরাষ্ট্রে মনু’র, খ্রীষ্টান রাষ্ট্রের ক্যানন ল’, এবং শারিয়া-রাষ্ট্রে শারিয়া আইনগুলো তার প্রমাণ। এর সাথে গত কয়েক দশকে যোগ হয়েছে “শারিয়া-পুলিশ” যার অত্যাচারে বিশেষ করে নারীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এদের কাজ হলো পিস্তল হাতে ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়ানো কোন নারী একটু টাইট পোশাক পরলো, কার একটু চুল বেরিয়ে আছে হিজাব থেকে, কে কার সাথে কোথায় যাচ্ছে, কে নামাজ পড়ছে না, কে রোজা রাখছে না, ইত্যাদি। এমনিতেই পিস্তল হাতে পড়লে মানুষের অহংবোধ বেড়ে যায়, তার ওপরে ধর্মের মালিকানা পেলে তো কথাই নেই। দেশে দেশে এদের অত্যাচারের কাহিনী ভয়ঙ্কর⎯একটা বলছি। ক’বছর আগে সৌদী আরবে মেয়েদের স্কুলে ব্যাপক আগুন লাগলে মেয়েরা হুড়োহুড়ি ক’রে বেরিয়ে আসে, তাতে তাদের মাথা থেকে স্কার্ফ পড়ে যায়। এই কারণে শারিয়া-পুলিশ তাদেরকে পেটাতে পেটাতে আবার জ্বলন্ত স্কুলে ঢুকিয়ে দেয়। যারা বাইরে থেকে সাহায্য করতে ছুটে এসেছিল তাদেরকেও পিটিয়ে সরিয়ে দেয়। ফলে অনেক মেয়ে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। ধর্মীয় রাষ্ট্রে ধর্মীয় উগ্রতা এমন উদগ্রই হয়ে থাকে।
যেহেতু বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতি বলতে ইসলামের নামে রাজনীতি বোঝায়, এবং যেহেতু সে-ক্ষেত্রে জামাতের নামই আসে প্রম তাই জামাতের দর্শন সম্বন্ধে জাতির জানা প্রয়োজন। যাঁর অপদর্শনের ভিত্তিতে বাংলাদেশে জামাত গঠিত হয়েছে (ইণ্ট্রোডিউসিং জামাতে ইসলামি বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ৫) সেই মওলানা মৌদুদি শান্তি ময় ধর্ম ইসলামকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে পরিণত করেছেন, হেদায়েতের কেতাব কোরাণকে আইনের বই করেছেন, রসুলকে প্রেসিডেণ্ট আর সেনাপতি করেছেন, এবং আলাহ- রসুল-কোরাণের নামে সন্ত্রাসকে বৈধ করেছেন। প্রচুর উদাহরণ আছে, একটা দিচ্ছি তাঁর তাফহিমুল কুরাণ গ্রন্থে সুরা নিসা’র আয়াত ২৪-এর ব্যাখ্যার সারাংশ ঃ “যুদ্ধবন্দিনীরা বৈধ কেননা তাদের বিবাহ বাতিল হইয়া যায়। সরকার কোনো সৈন্যকে যেই বন্দিনী দিবে শুধুমাত্র তাহার সাথেই যৌন সম্পর্ক করিতে পারিবে, সে নারীর ধর্ম যাহাই হোক না কেন। দাসীর সংখ্যার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নাই, বাচ্চা হইলে সেই বন্দিনীকে বিক্রয় করা যাইবে না” − www.islamicstudies.info/tafheem.php?sura=4&verse=23&to=25
অর্থাৎ বাচ্চা না হলে বা হবার আগে পর্যন্ত তাকে বিμμী করা যাবে। এগুলো বিচ্ছিনড়ব কিছু নয়, এগুলোই মৌদুদিবাদ। যুদ্ধবন্দিনীদের বিবাহ বাতিল হইয়া যায় এটা শারিয়া আইনেও আছে⎯ উমদাত আল্ সালিক আইন নং o.9.13। প্রশড়ব হলো, ওরা ওদের ধর্মীয় বিধানে বিয়ে করেছে, সেই বিয়ে বাতিল করার তুমি কে ? মতলবটা পরিষ্কার ধরা আছে তথাকথিত “সহি” হাদিসে, সুনান আবু দাউদ হাদিস নং ২১৫০। মুসলিম সৈন্যরা বন্দিনীদেরকে ধর্ষণ করতো, কখনো কখনো তাদের স্বামীদের সামনেই এবং “কোনো কোনো সৈন্য তাহা পছন্দ করিত না।” বুখারী ৩য় খণ্ড ৭১৮, মুসলিম ৩৪৩২ ইত্যাদিতেও বন্দিনী-ধর্ষণের কথা আছে। এসব হাদিস ইসলামের ওপরে কলঙ্ক ছাড়া আর কিছু নয়, আমাদের মঙ্গলের জন্যই এসব বাদ দিয়ে শুধু ভালোগুলো রাখতে হবে। যাঁরা এগুলো জেনে বিরক্ত বা μμুদ্ধ হবেন তাঁদের প্রতি আবেদন জানাই, এগুলো আমাদেরই কেতাব, এগুলোর মুখোমুখি হতেই হবে আমাদের। ইসলামি রাজনীতির ভিত্তিই হলো ঐধরনের হাদিস আর শারিয়া আইনগুলো । সমর্থন করার আগে ওগুলো পড়ে দেখুন। এধরনের অপতত্ত্বকে দেশ পরিচালনার ভার দেয়া যায় না।
জাতিকে বুঝতে হবে জামাত ঠিক কি কারণে আমাদের ওপরে গণহত্যা-গণধর্ষণে পাকিস্তানকে সμিμয় সমর্থন দিয়েছে। কারণটা হলো, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে যে কোনো বাধাকে যে কোনো উপায়ে সরিয়ে দেয়াটা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক, এটা তাদের ইবাদতের মধ্যে পড়ে। মিথ্যা বলাও তার মধ্যে পড়ে, তাদের পরিভাষায় এর নাম “তাক্কিয়া”। তাদের শারিয়া আইনেও আছে ঃ “যদি উদ্দেশ্যটি বাধ্যতামূলক হয় তবে সেই উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলা বাধ্যতামূলক” − শাফি আইন নং r.8.2। ইসলামী রাজনীতির উদ্দেশ্য পরিষ্কার, শারিয়া-ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কাজেই তারা যে দিনরাত মিথ্যা কথা বলে যা দেখে জাতি অভ্যস্ত, তার শেকড়ই ওখানে। অথচ আল্কো রাণে সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে − “মিথ্যা হইতে দূরে থাকো” − সুরা হজ্জ্ব, আয়াত ৩০।
এক ধর্মের রাষ্ট্র অন্য ধর্মের রাষ্ট্রকে বৈধতা দেয় ও উৎসাহিত করে। পাকিস্তান শারিয়া-রাষ্ট্র ভারতে ব্রাহ্মণবাদী মৌলবাদকে ও ইসরাইলে ইহুদী-রাষ্ট্রকে (যদিও সাংবিধানিকভাবে সেটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র) বৈধতা ও উৎসাহ দেয়। আমরা বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ইসলামী রাষ্ট্র বানাবো অথচ ওদের দেশে করতে দেবো না এ-দাবী অন্যায় ও অবৈধ। তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আছে বলেই তার প্রতিপক্ষ হিসেবে ইউরোপ আমেরিকা অষ্ট্রেলিয়াতে খ্রীষ্টান-রাষ্ট্রতত্ত্বের জনপ্রিয়তা বাড়বার সম্ভাবনা রয়েছে। তেমন হলে এসব দেশে কোটি কোটি মুসলমানের ওপরে কি কেয়ামত নেমে আসবে তা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয় না। ধর্মীয় রাজনীতিকে অবৈধ না করলে অসংখ্য ধর্মের অসংখ্য রাষ্ট্রে বিভক্ত পৃথিবীতে অনন্তকাল ধরে মানুষে মানুষে হানহানিকে অন্ততঃ তাত্ত্বিকভাবে বৈধ করা হয়। এসব কারণে এবং কোরাণ-রসুল মোতাবেক ইসলাম প্রচারকেরা ও অসংখ্য মুসলমান ইসলামে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি মেশানোর তীব্র বিরোধীতা করেছেন ও করেন।
এবারে আমরা দেখব আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, ইউরোপের কিছু দেশ ও ভারত সহ বিশ্বে অনেক দেশে ধর্মীয় রাজনীতি সাংবিধানিকভাবে বৈধ হলেও আমাদের মতো মুসলিম-প্রধান দেশে কেন তা নিষিদ্ধ করা দরকার। কথাটা আপাতদৃষ্টিতে যতটা স্ববিরোধী মনে হয় আসলে ততটাই সহজ। দুনিয়ায় বহু দেশে খ্রীষ্টান ও ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনৈতিক দল আছে। ওরাও এদের, অর্থাৎ ইসলাম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর, মতই নির্বাচন ক’রে ক্ষমতায় যেতে চায়। এদের মতো ইহুদীরাও দাবী করে ওদের ধর্মবিশ্বাস আসলে “সামগ্রিক জীবনবিধান”, হিন্দুদেরও অন্যকিছু মনে করার কারণ নেই। দু’পক্ষের অমিলও আছে। যেমন, ওদের আইনগুলো (হিন্দুদের মনু-আইন কিংবা ইহুদীদের হালাখা আইন) এদের শারিয়া আইনের মতো অতটা বিধিবদ্ধ (পড়ফরভরবফ) নয়, ধর্মীয় আইন না মানলে “মুরতাদ” হুংকারে হত্যার উসকানী ওদের নেই কিন্তু এদের আছে ; জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের নিয়ন্ত্রণ সহ বিশ্বময় অসংখ্য সংগঠনের রাজনৈতিক চাপ ওদের নেই কিন্তু এদের আছে ; রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো দেশে ওদের আইন চালু নেই কিন্তু এদের আছে (পাকিস্তান, ইরাণ, মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, ইত্যাদি) ; ছাপানড়বটা মুসলিম-প্রধান দেশের কেন্দ্রীয় সংগঠন ও-আই-সি’র আন্তর্জাতিক চাপের শক্তি ওদের নেই কিন্তু এদের আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমাদের প্রধান বিষয় হলো ক্ষমতায় গিয়ে কে কি করবে কারণ ওর ওপরেই জনগণের ভালোমন্দ নির্ভর করে। বাস্তবে আমরা দেখি পশ্চিমা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবলভাবে রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃ কীকরণের পক্ষপাতী, রাষ্ট্রযন্ত্রে ধর্মের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ তারা মোটেই পছন্দ করে না। সেজন্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো কখনো তেমন ভোট পায় না। এমনকি ক্যানাডায় এক ধর্মনিরপেক্ষ দল যখন নির্বাচনে ঘোষণা করেছিল তারা সরকার গঠন করলে সব ধর্মের স্কুলে সরকারী অনুদান দেবে তখন বিশ্বাসী ইহুদী-খ্রীষ্টানদের বড় অংশ তার প্রবল বিরোধীতা করেছিল। যদিও বহু আগে থেকে ক্যাথলিক স্কুলে সরকারী অনুদান দেয়াটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে (এটাও অনেকে পছন্দ করে না), তারপরেও নির্বাচনে শুধু সেই দলই হারেনি তার দলীয় প্রধানও হেরেছিল, এবং পরে তারা এ-ভুল স্বীকারও করেছিল। অর্থাৎ, পশ্চিমা দেশে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে গণসচেতনতার হিমালয় দাঁড়িয়ে আছে, সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ না হলেও এখানে ইহুদি বা খ্রীষ্টান রাষ্ট্রের সম্ভাবনা নেই এ-কথা বলা যায়। ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ওদের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ নয় বলে সে-ব্যাপারে ওদের ওপরে বিশ্বাসের চাপটাও নেই। কিন্তু মুসলিম-প্রধান দেশে সে-কথা বলা যায় না, সেখানে এ-ব্যাপারে গণসচেতনতা নেই, বিশ্বাসের চাপটাও অনেকেরই আছে। কাজেই দু’অঞ্চলের দু’রকম পদ্ধতি হওয়া দরকার। বলাই বাহুল্য, শারিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইসলামের অঙ্গ এ-তত্ত্বে অসংখ্য মুসলমান বিশ্বাস করেন না। তাঁরা ইসলামকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করার ঘোর বিরোধী।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই ওরা যদি কখনো ক্ষমতায় আসে তবে সেক্ষেত্রে কি হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাই হবে যা ভারতে চণ্ড ব্রাহ্মণবাদী দল বি.জে.পি. ক্ষমতায় এলে হয়েছিল । তারা দেশকে হিন্দু-আইনভিত্তিক ধর্মীয় রাষ্ট্র বানায়নি, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান বদলায়নি। ওটা ইহুদী-খ্রীষ্টান ধর্মীয় রাজনৈতিক দল বা বি.জে.পি. কারোই উদ্দেশ্যে নয়। এখানেই তাদের সাথে ইসলামী রাজনীতির মৌলিক পার্থক্য। ইহুদী-খ্রীষ্টান বি.জে.পি. দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্বতিকে ধ্বংস করতে নয়। অন্যদিকে ইসলামী রাজনীতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ধ্বংস করার জন্যই। ইসলামী রাজনীতি যখনই ক্ষমতা পেয়েছে অবিলম্বে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে ধ্বংস ক’রে ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। করেছে কারণ ওটাই ওদের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ এবং সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য। সেইসব তথাকথিত ইসলামী দেশের অভিজ্ঞতা আমাদের কি শেখায় ? এই শেখায়, ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রতিটি দেশের নারীরা ও অমুসলিমেরা নির্যাতিত হয়েছেন, ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে, এবং বিশ্ব-মুসলিমের অগ্রগতি ব্যহত হয়েছে।
ধর্মীয় রাজনীতি কি গণতান্ত্রিক হতে পারে ? না, পারে না। “জামাত কি গণতান্ত্রিক ?” এই বিষয়ে জামাতের বর্তমান তত্ত্বগুরু জনাব শাহ্ আবদুল হানড়বানের সাথে আমার বিতর্ক হয়েছিল। উনি এক মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন সেμেμটারী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান ছিলেন। আমাদের ইসলামী ফাউণ্ডেশনের প্রকাশিত তিন খণ্ডের শারিয়া বই “বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন”-এর লেখক কমিটির একজন সম্মানিত সদস্য উনি। উনি দাবী করছিলেন জামাত গণতান্ত্রিক দল কারণ তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পালন করে এবং নির্বাচনে অংশ নেয়। আমার দাবী ছিল জামাত গণতন্ত্রের প্রধান শত্র“, তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পালন করে এবং নির্বাচনে অংশ নেয় শুধু গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্যই। আমি একের পর এক দলিল দেখাচ্ছিলাম জামাতের দলিল থেকেই, আর উনি শুধু অভিমত পেশ করছিলেন। আলোচনাটা এখানে পাওয়া যাবে ঃ http://www.mukto-mona.com/Articles/fatemolla/debate_hannan/hannan1.htm
এ নিবন্ধে যা বলেছি দলিল-প্রমাণ দিয়ে বলেছি। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসভিত্তিক সামাজিক বিবর্তনে কারো কথাই শেষ কথা নয়। অনেকে অন্যরকম ভাববেন সেটাই স্বাভাবিক।
অহংবোধ বা অন্ধবিশ্বাসের নয়, হিংস্র-সঙ্ঘাতের তো নয়ই বরং চিন্তার সঙ্ঘাতই সামাজিক অগ্রগতির চালিকাশক্তি ॥