shariakibole.com

Category Archives: Blog

ইসলামে বাল্যবিবাহ

 

দেশে বাল্যবিবাহের আইন ও তার প্রয়োগের দড়ি-টানাটানি চলছে তো চলছেই। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে মানবাধিকারকর্মীদের আন্দোলন, অন্যদিকে এর পক্ষে বেশিরভাগ ইমাম-আলেমদের অবস্থান। তাদের প্রধান যুক্তি সহি বুখারির হাদিস:

“রাসুল (সা.) বিবি আয়েশাকে (রা.) বিয়ে করিয়াছিলেন ছয় বছর বয়সে, নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন নয় বছর বয়সে।”

(বুখারি ৭ম খণ্ড-৬৪, ৫ম খণ্ড-২৩৪, ২৩৬)

অথচ ছয় বছরে বিয়ে হয়েছে এটা নির্ভরযোগ্য নয় তাঁর নিজের কথাতেই:

“বিবি আয়েশা (রা.) বলছেন, বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল সাত বছর।” (সহি মুসলিম ৮-৩৩১১)

এক বছরের তফাৎ বেশি না মনে হতে পারে, কিন্তু এ থেকে প্রমাণ হয় বুখারির ওই ছয় বছর, নয় বছরের দলিল প্রশ্নাতীত নয়।

বাল্যবিবাহের বিপক্ষে অন্য যেসব দলিল আছে তা উপেক্ষা করে এই একটা মাত্র ঘটনার ওপরে নির্ভর করে বাল্যবিবাহ চলে আসছে। অথচ ড. জাকির নায়েকসহ বহু ইসলামি বিশেষজ্ঞ এই ‘ছয় বছর-নয় বছর’-এর বিরুদ্ধে চিরকাল প্রতিবাদ করেছেন। কিসের ভিত্তিতে করেছেন সেটাই আমরা দেখব, কিন্তু প্রথমে দেখা যাক এ ঘটনার ভিত্তিতে ইসলামবিরোধীরা রাসুলকে (সা.) ‘শিশু-ধর্ষক’ বলে যে অপবাদ দিয়ে থাকে সেটা কেন ভিত্তিহীন।

শিশু নিপীড়ন মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত পুরুষ কম বয়সের শিশুদের সঙ্গে যৌনসংসর্গ করতে সর্বক্ষণ সুযোগ খুঁজতে থাকে। মনে রাখতে হবে সেই সময়ে সমাজ, পরিবার, অর্থনীতি, রাজনীতি, যুদ্ধনীতি এমনকি প্রতিটি মানুষের মনোজগতের ওপর রাসুলের (সা.) সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ ছিল। লক্ষ অনুসারীরা তাঁর জন্য নিজেদের ‘পিতামাতা উৎসর্গ’ করার কথা সর্বক্ষণ বলতেন; তিনি চাইলে অনায়াসে শত শত নয়, বরং হাজার হাজার শিশুর সঙ্গে যৌন সংসর্গ করতে পারতেন। অথচ তেমন কিছুর কোনো দলিল নেই। বরং তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র আয়েশা (রা.) ছিলেন কুমারী, বাকিরা প্রাপ্তবয়স্কা বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা, কেউ কেউ আবার তেমন সুন্দরীও ছিলেন না। কাজেই ‘শিশু নিপীড়ন’ তত্ত্বটা তাঁর বেলায় একেবারেই খাটে না।

২৫ বছরের দুরন্ত যৌবনে তাঁর প্রথম বিয়েই ছিল ৪০ বছরের বিধবা বিবি খাদিজার সঙ্গে এবং তিনি বিবি খাদিজার (রা.) মৃত্যুর আগে দ্বিতীয় বিবাহ করেননি।

‘ছয় বছর-নয় বছর’:

• মনে রাখতে হবে ১০০ বছর আগেও যেখানে কেউ দিন-ক্ষণ-বছরের দলিল রাখত না, সেখানে আমরা এক হাজার ৪০০ বছর আগের কথা বলছি। অতীতে অনেক দেশে (এমনকি বর্তমানেও কিছু অনুন্নত এলাকায়) সময় এবং বয়স মনে রাখার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রথা চালু ছিল না। তখন তারা কোনো বিশেষ ঘটনার সাহায্যে, যেমন যুদ্ধ, খরা, অথবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভিত্তিতে বছর মনে রাখত। এমনকি ইতিহাসের পাতায় সভ্যতার শীর্ষে যে রোমান জাতি, তাদের মধ্যেও এই প্রথা চালু ছিল।

নবীর (সা.) জন্মের বছরে ইয়েমেনের রাজা আবরাহা তার হাতির বহর নিয়ে মক্কা আক্রমণ করে। তাই সেই বছরকে বোঝাতে মক্কার লোকেরা ‘হস্তীর বৎসর’ উল্লেখ করত। এই প্রথা স্মৃতির ওপর নির্ভরশীল, তাই বয়সের ও সময়ের হিসাবে অনিচ্ছাকৃত ভুল ইতিহাসে ধরা পড়ে। তারপরও, যে দলিলগুলো আমাদের হাতে আছে তার ভিত্তিতে কয়েকটা সংখ্যা দেখা যাক।

• রাসুল (সা.) নবুয়ত পেয়েছিলেন ৬১০ সালে;
• রাসুল (সা.) মদীনায় হিজরত করেছিলেন ৬২২ সালে;
• রাসুল (সা.) আয়েশাকে (রা.) ঘরে তুলেছিলেন ৬২২ সালে;
• বদর যুদ্ধ হয় ৬২৪ সালে এবং
• ওহুদ যুদ্ধ হয় ৬২৫ সালে।

অংক:

• ইবনে ওমর বলেন: “রাসুল (সা.) আমাকে (৬২৫ সালে) ওহুদ যুদ্ধে যোগ দিতে দেননি, কারণ তখন আমার বয়স ছিল ১৪। কিন্তু খন্দক যুদ্ধে আমি যোগ দিতে পেরেছিলাম, কারণ তখন আমার বয়স ১৫ ছিল।”

(বুখারি ৩-৮৩২ ও তফসির ইবনে কাথির ৪-২৮৬)

• ৬২৫ সালে বিবি আয়েশা (রা.) বদর যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। (বুখারি ৪-১৩১) কাজেই বিয়ের সময় ৬১৯ সালে তাঁর বয়স ছিল কমপক্ষে ৯ বছর এবং ৬২২ সালে ‘ঘরে তোলার’ সময় তাঁর বয়স অবশ্যই ১২ বছরের বেশি ছিল।

• ৬১৫ সালে পিতা হজরত আবু বকর (রা.) এক লোকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে ঠিক করেছিলেন। কন্যাশিশুর বিয়ে প্রস্তাব করা কোনো পিতার পক্ষে সম্ভব হলেও ব্যতিক্রম মাত্র। তাই ৬১৫ সালে তিনি প্রাপ্তবয়স্কা ছিলেন সে সম্ভাবনাই বেশি। সে হিসাবে চার বছর পর রাসুলের (সা.) সঙ্গে ৬১৯ সালে বিয়ের সময় তাঁর প্রাপ্তবয়স্কা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

• ৬১২ সালের দিকে কোরআনের ৫৪তম অধ্যায় সুরা ক্বামার নাজিলকালে বিবি আয়েশা (রা.) একজন কিশোরী (জারিয়াহ) ছিলেন এবং তিনি আয়াত মুখস্থ বলতে পারতেন। (বুখারি ৬-৫১৫) সে হিসাবে তাঁর বয়স তখন ছয়ের বেশি হওয়াই সম্ভব এবং ৬২২ সালে ‘ঘরে তোলার’ সময় তাঁর বয়স অন্তত ১৬ বছর।

• ইবনে হিশাম/ইসহাকের বিখ্যাত ‘সিরাত’ কেতাবে আমরা দেখি তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন ৬১০ সালে। ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য ভালো-মন্দ বোঝার কিছুটা ক্ষমতা থাকবে বলেই আশা করা যায়। ৬১০ সালে যদি তাঁর বয়স তিন বছরও (খুব সম্ভব তার চেয়ে বেশি) হয়ে থাকে, তবে ৬২২ সালে ‘ঘরে তোলার’ সময় তাঁর বয়স অন্তত ১৫ বছর।

• ১৪০০ বছর আগে নয় বছরের বালিকার বিয়ে স্বাভাবিক ধরা হত। তখনকার সামাজিক ব্যবস্থা, জীবনযাপন প্রণালী, প্রাকৃতিক অবস্থা এবং রূঢ় আবহাওয়া এর কারণ হতে পারে। বাইবেলেও এর ইঙ্গিত আমরা পাই। ইসলামের শত্রুপক্ষের লোকেরা রাসুলের (সা.) অনেক সমালোচনা করেছে, কিন্তু এ বিষয়ে কখনও কোনো কটু মন্তব্য করেনি।

• ৬১৫ সালে হজরত আবু বকর (রা.) মুত’আমের পুত্রের সঙ্গে আয়েশার (রা.) বিবাহের চিন্তা করেছিলেন। মুত’আম তার পুত্রের এই বিবাহে রাজি হয়নি, কারণ তখন হজরত আবু বকর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তখন অবশ্যই বিবি আয়েশার (রা.) বয়স দুইও হয়ে থাকে সেই হিসাবে ৬২২ সালে তাঁর বয়স অবশ্যই নয়ের বেশি ছিল।

• হজরত আবু বকরের (রা.) চার সন্তানেরই জন্ম হয়েছিল আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগে, যখন ইসলাম প্রচার শুরু হয়নি। এই যুগের পরিসমাপ্তি হয় ৬১০ সালে। সেই সূত্রে ৬২২ সালে বিবি আয়েশার (রা.) বয়স ন্যূনতম বয়স ১২ বছর ছিল।

• বিবি ফাতেমা (রা.) বিবি আয়েশার (রা.) পাঁচ বছরের বড় ছিলেন। মুহাম্মদের (সা.) বয়স যখন ৩৫ বৎসর তখন ফাতেমার (রা.) জন্ম হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী বিবি আয়েশা (রা.) রাসুলাল্লার (সা.) চেয়ে ৪০ বছরের ছোট ছিলেন, অর্থাৎ বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল ১২।

• দলিল আরও অনেক আছে, যা কখনও পরস্পরবিরোধী, তাই তা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।

কোরান:

“এতিমদের প্রতি বিশেষ নজর রাখবে যে পর্যন্ত না তারা বিয়ের বয়সে পৌঁছে। যদি তাদের মধ্যে বুদ্ধি-বিবেচনার উন্মেষ আঁচ করতে পার, তবে তাদের সম্পদ তাদের হাতে অর্পন করতে পার।” (সুরা নিসা আয়াত ৬)

কী মনে হয়? “যে পর্যন্ত না তারা বিয়ের বয়সে পৌঁছে….তাদের মধ্যে বুদ্ধি-বিবেচনার উন্মেষ আঁচ করতে পার”— এর অর্থ বিয়ের একটা বয়স আছে সেটা তখনই হবে যখন তাদের মধ্যে বুদ্ধি-বিবেচনার উন্মেষ হবে। কথাটা নাবালিকাদের ক্ষেত্রে খাটে না, বাল্যবিবাহ ওখানেই সুস্পষ্ট ভাষায় নাকচ করেছে কোরান।

বাস্তবতা:

যারা বাল্যবিবাহ সমর্থন করেন, তারা কি ওই কচি মেয়েটার মুখের দিলে তাকিয়েছেন একবার? বিশ-পঁচিশ বছরের তরুণের দেহে দুর্দান্ত খেলা করে প্রচণ্ড যৌবন, আর ওদিকে ওই বাচ্চা মেয়েটার না শরীর তৈরি, না মন। সেখানে প্রতিদিন ওই বাচ্চাটাকে কি দোজখের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তার শরীরের ওপর কি মর্মান্তিক অত্যাচার হয়, তা কি বাল্যবিবাহ সমর্থনকারীরা ভেবেছেন একবারও?

অন্ধের মতো হাদিস অনুসরণ করার উদগ্র বাসনা এভাবেই জীবন ধ্বংস করে, ইসলামেরও বদনাম হয়। তার ওপর আছে ওই কচি শরীরে সময়ের আগেই মাতৃত্বের চাপ।

আরও বলতে হবে?

 

Source: http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/46058

জঙ্গি উচ্ছেদে শরিয়া আইন

দেশে ইসলামের নামে জঙ্গি-বিস্ফোরণ ঘটেছে। সরকার প্রচণ্ড বিক্রমে জঙ্গি দমন ও নিধন করছে। কিন্তু শুধু বিষফল নিধন করেই স্থায়ী সফলতা আসবে না যদি বিষবৃক্ষ উচ্ছেদ করা না হয়।

জঙ্গিরা চায় কী? দেশ ও দুনিয়া যেভাবে চলছে তাতে ওরা অত্যন্ত বিরক্ত, ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ। ওদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা মানুষ খুন করে হলেও শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু যে ‘আল্লাহর আইন’ প্রতিষ্ঠা করতে ওরা খুন করছে খুন হচ্ছে সে আইনগুলো ওরা যদি একটিবার পড়ে দেখত, তাহলে ওরা এ সর্বনাশা পথে পা বাড়াত না, বুঝতে পারত ওদের ধর্মীয় আবেগ নিয়ে কী মারাত্মক ষড়যন্ত্র হয়েছে।

এখানে সেরকম কিছু আইনের উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

১. ‘রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা’ আইনে যে আটটা শর্ত আছে পুরুষ হওয়া তার অন্যতম। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ৩য় খণ্ড ধারা ৯০০।

২. তওবা করলে গণহত্যাকারী, গণধর্ষণকারী, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজকারীদের শাস্তি হবে না। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড ধারা ১৩।

৩. ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে হুদুদ মামলা করা যাবে না। হানাফি আইন পৃষ্ঠা ১৮৮ এবং ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ৩য় খণ্ড নং ৯১৪গ।

হুদুদ মামলা হল খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, মদ্যপান, মানহানী ও ইসলাম ত্যাগ।

৪. হুদুদ মামলায় নারী-সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। হানাফি আইন, পৃষ্ঠা ৩৫৩, শাফি’ই আইন ০.২৪.৯, ‘ক্রিমিন্যাল ল ইন ইসলাম অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্লড’ পৃষ্ঠা ২৫১, মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত ‘বাংলা কোরান’ পৃষ্ঠা ২৩৯, ‘পেনাল ল অব ইসলাম’ পৃষ্ঠা ৪৪, ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড ধারা ১৩৩ ও ২য় খণ্ড ধারা ৫৭৬।

৫. হুদুদ মামলায় নারী-বিচারক অবৈধ। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ২য় খণ্ড ধারা ৫৫৪।

(৬) (স্বামীর) বৌ-তালাকে সাক্ষ্য শর্ত নহে। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড, ধারা ৩৪৪।

৭. বোবার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১১, ধারা ১৪৯। দাস-দাসী, গায়িকা এবং সমাজের নিচু ব্যক্তির (রাস্তা পরিষ্কারকারী বা শৌচাগারের প্রহরী ইত্যাদি) সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। হানাফি আইন পৃষ্ঠা ৩৬১, শাফি’ই আইন ০.২৪.৩.৩, পেনাল ল অব ইসলাম পৃষ্ঠা ৪৬, ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৬৩।

৮. কোনো কারণে ধর্ষকের শাস্তি মওকুফ হইলে ধর্ষক ধর্ষিতাকে মোহরের সমান টাকা দিবে। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ৩০১; শাফি’ই আইন এম.৮.১০।

৯. খাবার, বাসস্থান ও পোশাক দিতে স্বামী বাধ্য থাকবে শুধুমাত্র বাধ্য স্ত্রীকে, অবাধ্য স্ত্রীকে নয়। এর বাইরের সব খরচ এমনকি ডাক্তারের, ওষুধের বা সৌন্দর্য্য-চর্চার খরচ ইত্যাদি হবে স্বামীর করুণা ও দয়া। হানাফি আইন পৃষ্ঠা ১৪০; শাফি’ই আইন এম.১১.৪।

১০. “স্ত্রীর যে প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করা স্বামীর জিম্মায় ওয়াজিব (বাধ্য), তা চারটি বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ– আহার, পানীয়, বস্ত্র ও বাসস্থান। স্বামী এর বেশি কিছু স্ত্রীকে দিলে অথবা ব্যয় করলে তা হবে অনুগ্রহ, অপরিহার্য নয়।” মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত ‘বাংলা কোরান’, পৃষ্ঠা ৮৬৭। বলাই বাহুল্য, স্ত্রী অবাধ্য কি না সেটা ঠিক করবে স্বামী নিজেই।

১১. বাবা-মা, দাদা-দাদি বা নানা-নানি যদি ছেলে-মেয়ে বা নাতি-নাতনিকে খুন করে তবে খুনির মৃত্যুদণ্ড হবে না। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড ধারা ৬৫ ক ও খ; শাফি’ই আইন ০.১.২.৪।

১২. হুদুদ মামলায় পারিপার্শ্বিক প্রমাণ চলবে না, চাক্ষুষ সাক্ষী থাকতে হবে – বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ২য় খণ্ড ধারা ৬০০)। এতে মুশকিল হল, চুরি-ডাকাতি-খুনের চাক্ষুষ সাক্ষী প্রায়ই পাওয়া যায় না, পারিপার্শ্বিক প্রমাণেই অপরাধীর শাস্তি হয়। এ আইন হলে বহু অপরাধীর শাস্তি হবে না।

১৩. তাৎক্ষণিক তালাকের পর স্ত্রী খাবার-বাসস্থান কিছুই পাবে না। সাধারণ তালাকের পর স্ত্রী তিন মাসের জন্য খোরপোষ পাবে। তারপর তারা কোথায় যাবে কী খাবে তার উল্লেখ নেই। হানাফি আইন, পৃষ্ঠা ১৪৫; শাফি’ই আইন এম.১১.১০, ১ ও ৩, পৃষ্ঠা ৫৪৬।

১৪. “কোনো অমুসলমানকে খুন করার অপরাধে কোন মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড হবে না।” পেনাল ল অব ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৪৯।

১৫. নিহতের পুত্র ও কন্যা থাকলে খুনিকে মাফ করতে শুধু পুত্ররাই পারে, কন্যারা নয়। ‘শরিয়া দি ইসলামিক ল’, ড. আবদুর রহমান ডোই, পৃষ্ঠা ২৩৫। এর মধ্যে রক্তমূল্যের দাবিও থাকার কথা।

১৬. আত্মীয়ের বাসা থেকে চুরি করলে বা মেজবানের বাসা থেকে মেহমান চুরি করলে তার হুদুদ শাস্তি হবে না। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড ধারা ১৫৬ ও ১৫৭।

(১৭) বিবাহিতা যুদ্ধ-বন্দিনীদের বিয়ে তৎক্ষণাৎ বাতিল হয়ে যাবে। শাফি’ই আইন ০.৯.১৩।

১৮. যুদ্ধবন্দিনীদের সঙ্গে দৈহিক সংসর্গ করা (অর্থাৎ ধর্ষণ – লেখক) বৈধ। মউদুদি, তাফহীমুল কুরআন, সুরা নিসা আয়াত ২৪ এর ব্যাখ্যা।

১৯. মদ্যপানের সাক্ষী হতে হবে শুধুমাত্র দুজন পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষ্য। মেয়েদের বা পুরুষ-মেয়েদের মিলিত সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড ধারা ১৭৪।

২০. স্বামী তার স্ত্রীকে যখন ইচ্ছে তখনই তাৎক্ষণিকভাবে পুরো তালাক দিতে পারবে। কোনো কোনো কেতাবে আছে অত্যাচারের চাপে, নেশার ঘোরে বা হাসি-ঠাট্টাতে ‘তালাক’ উচ্চারণ করলেও পুরো তালাক হয়ে যাবে। হানাফি আইন পৃষ্ঠা ৮১ ও ৫২৩, শাফি’ই আইন এন.৩.৫, ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড ধারা ৩৫১, ৩৪৭, ৩৪৯, ‘বেহেশতি জেওর’ (দ্বীন কি বাতেঁ – মওলানা আশরাফ থানভি) আইন নং ১৫৩৭, ১৫৩৮, ১৫৪৬ ও ২৫৫৫।

২১. “যে কোনো কর্মের বাস্তব সংঘটনই উহাকে অপরাধকর্মে পরিণত করে। বাস্তবে সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো কর্মের জন্য কাহাকেও দায়ী করা যায় না।” ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ৩য় খণ্ড ধারা ১২৮২।

অর্থাৎ হামলা বা খুন করার আগে জঙ্গিদের বা ডাকাতদের গোপন পরিকল্পনা-বৈঠক বন্ধ করা যাবে না। এ আইন হলে অপরাধীদের পোয়াবারো। কিন্তু অনেক সময়ই গুপ্তচরের সাহায্যে পুলিশ চুরি-ডাকাতি বোমাবাজি-খুন-গণহত্যা প্লেন-হাইজ্যাকের পরিকল্পনা আগে থেকেই জেনে ফেলে ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে। এতে জনগণের জানমালের সুরক্ষা হয় এবং অপরাধীরা ভয় পায়।

এই শারিয়া আইনগুলো দেখানো হয়েছে প্রধানত: ১. হানাফি আইনের বই ‘হেদায়া’, যেটা ইংল্যাণ্ডের ব্যারিস্টারি সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত, ২. শাফি আইনের বই ‘উমদাত আল সালিক’, যেটাকে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় সই ও স্ট্যাম্প দিয়ে সত্যায়িত করেছে, ৩. বি-ই-আ, বাংলাদেশ ইসলামি ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ৪. পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শরিয়া সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. আবদুর রহমান ডোইয়ে ‘শরিয়া দি ইসলামিক ল’, ৫. মওলানা মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত বাংলা ‘কোরান’, ৬. ‘ক্রিমিন্যাল ল ইন ইসলাম অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্লড’, (৭) ‘পেনাল ল অফ ইসলাম’ ইত্যাদি থেকে।

‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ ও মওলানা মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত ‘বাংলা কোরান’ হাতের কাছেই আছে, ‘উমদাত আল সালিক’ এখন অন লাইনে ফ্রি পাওয়া যায়, আপনারা আইনগুলো মিলিয়ে দেখতে পারেন। হানাফী আইনের বই ‘হেদায়া’ এখনও অনলাইনে আসেনি।

এখন আপনারাই বলুন এসব আইন দিয়ে কি একটা রাষ্ট্র চালানো সম্ভব? তওবা করলেই গণহত্যাকারী, গণধর্ষণকারীদের শাস্তি হবে না? কেন হবে না? চোখের সামনে খুন-জখম-চুরি-ডাকাতি হবে আর ‘নারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়’? কেন? কোরান কোথায় নারীর সাক্ষ্য নিষিদ্ধ করেছে? রাসুল (সা.) কোথায় করেছেন? নারীরা বিচারক হতে পারবেন না কেন? স্বামীর কেন অধিকার থাকবে স্ত্রীকে তাৎক্ষণিক তালাক দেওয়ার? কোনো অমুসলমানকে খুন করার অপরাধে কোনো মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড হবে না কেন? নারী নেতৃত্ব তো কোরানেই বৈধ করা আছে, মুসলিম-বিশ্বের ইতিহাসেও অন্তত ১২ জন রানীর সফল ও দীর্ঘ শাসন আছে। ‘(স্বামীর) বৌ-তালাকে সাক্ষ্য শর্ত নহে’ কেন? খুলুন কোরান, সুরা ত্বালাক, আয়াত ২: “তোমরা যখন স্ত্রীদিগকে তালাক দিতে চাও তখন দুইজন সাক্ষী রাখিবে।”

শরিয়াতে এ রকম আরও শত শত ইসলামবিরোধী, নারীবিরোধী, মানবতাবিরোধী আইন আছে। জঙ্গিদের উৎসই হল এসব আইন প্রতিষ্ঠা করার বিভ্রম। এই বিভ্রমের কারণেই কোটি কোটি মুসলিম এমনকি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইসলামি সংগঠন ‘নাহদালতুল উলামা’ শরিয়া আইনের কঠিন বিরুদ্ধে। জাতিকে যদি এসব আইন দেখানো যায়, তবে আশা করা যায়, জাতি ওই ‘আল্লাহর আইন’-এর বিভ্রম থেকে বেরিয়ে আসবে, জঙ্গিপনার শেকড় উচ্ছেদ হবে। বিষবৃক্ষের শেকড় অক্ষত রেখে ডালপালা কেটে লাভ নেই। কারণ ওই শেকড় থেকে আবার ডালপালা গজাবে।

সূত্র বিশেষে আইনের কিছু পার্থক্য দেখা যায়, কারো দরকার হলে শরিয়া বইয়ের আইনগুলোর পৃষ্ঠার ছবি পাঠানো যেতে পারে।

Source: http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/46629

মূর্তি বিড়ম্বনার ইসলামি আঙ্গিক

দেশে এখন মূর্তি ও ভাস্কর্য নিয়ে উত্তেজনা চলছে। বিষয়টির সঙ্গে হেফাজতিরা ইসলামকে জড়িয়ে ফেলেছে। তাই চলুন আমরা সূত্র ধরে দেখি এ ব্যাপারে কোরান, হাদিস, সিরাত (ইবনে হিশাম ইবনে ইবনে ইসহাক), তারিখ আল তারারি ও অন্যান্য দলিল কী বলে।

প্রথমেই তিনটে শব্দ বুঝে নেওয়া যাক: প্রতিমা, ভাস্কর্য ও মূর্তি। প্রতিমা হল মানুষ যার আরাধনা উপাসনা করে, ইহকালে-পরকালে মঙ্গল চায়, ভুলের ক্ষমা চায় ইত্যাদি। ভাস্কর্য্য হল মানুষসহ কোনো প্রাণী বা কোনো কিছুর মূর্তি যাকে মানুষ রাখে সম্মান দেখতে বা সৌন্দর্য্য বর্ধন করতে, যার মানুষ আরাধনা বা উপাসনা করে না। এবারে অন্যান্য দলিলের দিকে তাকানো যাক, সেখানে আমরা দেখব হযরত মুহাম্মদের (সা.) বাড়িতে মূর্তি ছিল তাঁর সম্মতিক্রমেই। সব দলিলের শেষে আমরা কোরানে যাব এবং দেখতে পাব আল্লাহর নির্দেশেই এক পয়গম্বরের প্রাসাদে ভাস্কর্য ছিল।

কোরানে যাওয়ার আগে প্রথমেই হাদিস ও অন্যান্য দলিল। কাবাতে রাসূল (সা.) লাত, মানাত, উজ্জা, হোবল, ওয়াদ ইত্যাদির প্রতিমা ভেঙেছিলেন, এগুলোর আরাধনা করা হত বলে। ভাস্কর্য ও মূর্তির বিপক্ষে কিছু হাদিস আছে, কিন্তু সাধারণত বিপক্ষের দলিলে আমরা ব্যক্তির নাম ও ঘটনার বিবরণ পাই না, যা পক্ষের হাদিসগুলোতে পাই। পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ।

(ক) সহি বুখারি ৮ম খণ্ড হাদিস ১৫১:
আয়েশা বলিয়াছেন, আমি রাসুলের (সা.) উপস্থিতিতে পুতুলগুলি লইয়া খেলিতাম এবং আমার বান্ধবীরাও আমার সহিত খেলিত। যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) আমার খেলাঘরে প্রবেশ করিতেন, তাহারা লুকাইয়া যাইত, কিন্তু রাসুল (সা.) তাহাদিগকে ডাকিয়া আমার সহিত খেলিতে বলিতেন।

(খ) সহি আবু দাউদ বুক ৪১ হাদিস নং ৪৯১৪:
বিশ্বাসীদের মাতা আয়েশা (রা.) বলিয়াছেন, যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) তাবুক অথবা খাইবার যুদ্ধ হইতে ফিরিলেন তখন বাতাসে তাঁহার কক্ষের সামনের পর্দা সরিয়ে গেলে তাঁহার কিছু পুতুল দেখা গেল। তিনি [(রাসুল (সা.)] বলিলেন, “এইগুলি কী?” তিনি বলিলেন, “আমার পুতুল।” ওইগুলির মধ্যে তিনি দেখিলেন একটি ঘোড়া যাহার ডানা কাপড় দিয়া বানানো হইয়াছে এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহা কি যাহা উহার উপর রহিয়াছে?” তিনি উত্তরে বলিলেন, “দুইটি ডানা।” তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডানাওয়ালা ঘোড়া?” তিনি উত্তরে বলিলেন, “আপনি কি শোনেননি যে সুলেমানের ডানাওয়ালা ঘোড়া ছিল?” তিনি বলিয়েছেন, ইহাতে আল্লাহর রাসুল (সা.) এমন অট্টহাসি হাসিলেন যে আমি উনার মাড়ির দাঁত দেখিতে পাইলাম।”

(গ) সহি মুসলিম – বুক ০০৮, নং ৩৩১১:
আয়েশা (রা.) বলিয়াছেন যে আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁহাকে সাত বৎসর বয়সে বিবাহ করিয়াছিলেন (যদিও অন্য রেওয়াতে আমরা পাই ছয় বছর: হাসান মাহমুদ) এবং তাঁহাকে নয় বৎসর বয়সে কনে হিসেবে তাঁহার বাসায় লইয়া যাওয়া হয়, এবং তাঁহার পুতুলগুলি তাঁহার সাথে ছিল এবং যখন তিনি দেহত্যাগ করিলেন তখন তাঁহার বয়স ছিল আঠারো।

(ঘ) সহি মুসলিম – বুক ০৩১ নং ৫৯৮১:
আয়েশা (রা.) বলিয়াছেন যে তিনি আল্লাহর রাসুলের (সা.) উপস্থিতিতে পুতুল লইয়া খেলিতেন এবং যখন তাঁহার সঙ্গিনীরা তাঁহার কাছে আসিত তখন তাহারা চলিয়া যাইত। কারণ তাহারা আল্লাহর রাসুলের (সা.) জন্য লজ্জা পাইত। যদিও আল্লাহর রাসুল (সা.) তাহাদিগকে তাঁহার কাছে পাঠাইয়া দিতেন।

সহি বুখারির ব্যাখ্যা শুনুন। হাদিসটার ফুটনোটে ‘ফতহুল বারি’র লেখক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীর উদ্ধৃতি: “পুতুল ও একই রকম ইমেজ অবৈধ কিন্তু ইহা বৈধ করা হইয়াছিল তখন আয়েশার (রা.) জন্য। কারণ তিনি ছিলেন ছোট বালিকা, তখনও তিনি বয়স্কা হননি।” (ফতহুল বারি, পৃষ্ঠা ১৪৩, ১৩ খণ্ড)

নবী (সা.) পুতুল বৈধ করেছিলেন এটাই আসল কথা। কী কারণে করেছিলেন সেটা ইমামের জানা সম্ভব নয়। কারণ তিনি রাসুলের (সা.) ৮০০ বছর পরের হাজার মাইল দূরে মিসরের লোক, রাসুলের (সা.) সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়নি, কথাও হয়নি। ওটা তাঁর ব্যক্তিগত মত মাত্র।

এবারে আরও কিছু সংশ্লিষ্ট দলিল।

তখন কাবার দেয়ালে ৩৬০টি মূর্তি (বুখারি ৩য় খণ্ড – ৬৫৮) ও অনেক ছবির সঙ্গে ছিল হযরত ঈসা (আ.) ও মাতা মেরির ছবিও। উদ্ধৃতি দিচ্ছি, “রাসুল (সা.) হযরত ঈসা (আ.) ও মাতা মেরির ছবি বাদে বাকি সব ছবি মুছিয়া ফেলিতে নির্দেশ দিলেন।” (সিরাত (ইবনে হিশাম/ইবনে ইশাক-এর পৃষ্ঠা ৫৫২)

এবারে সাহাবি ও খলিফারা।

দুনিয়ার প্রায় এক চতুর্থাংশ জয় করেছিলেন মুসলিমরা। সবই অমুসলিমের দেশ এবং সেখানেও নিশ্চয়ই অনেক প্রতিমা-ভাস্কর্য ছিল, সেগুলোর তো সবই ভেঙে দেওয়ার কথা। কিন্তু সেখানেও আমরা তেমন দলিল পাই না। ৭১০ সালে হিন্দু রাজা দাহিরের দেশ সিন্ধু জয় করার পর কয়টা মূর্তি ভেঙেছিলেন মুহম্মদ বিন কাশেম? ভাস্কর্য-মূর্তি তো দূরের কথা কোনো প্রতিমাও ভেঙেছেন বলে জানা যায় না।

রাসুলের (সা.) অজস্র ছবি স্বচক্ষে দেখতে চাইলে ইরানে চলে যান। দেখবেন দেয়ালে ঝুলানো সুদৃশ্য কার্পেটে আছে মা আমিনার কোলে শিশু নবী (সা.), সাহাবি পরিবেষ্টিত নবীজি (সা.), আসমানে বোরাখে উপবিষ্ট নবীজি (সা.) ইত্যাদি।

গুগল করলেই পেয়ে যাবেন– সবই কাল্পনিক ছবি অবশ্য– হাজার বছর ধরে আছে ওগুলো। ইরান এখন তো শিয়া দেশ, কিন্তু ৭৫০ সালে আব্বাসিরা দখল করার আগে পর্যন্ত ওটা সুন্নি উমাইয়াদের রাজত্ব ছিল।

এবারে সাম্প্রতিক কাল। ছবি তো ছবি, নবীজির (সা.) আট ফুট উঁচু, ১০০০ পাউণ্ড ওজনের মার্বেল পাথরের ভাস্কর্যও ছিল দীর্ঘ ৫৩ বছর। ১৯০২ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ২৫ নং স্ট্রিট ম্যাডিসন এভিনিউতে অবস্থিত ম্যাডিসন পার্কের মুখোমুখি নিউইয়র্ক আপিল বিভাগের কোর্ট দালানের ছাদে। ইতিহাসের আরও নয়জন আইনদাতাদের সঙ্গে নবীজির (সা.) আট ফুট উঁচু মার্বেল পাথরের ভাস্কর্যও রাখা ছিল সসম্মানে।

গুগলে ‘এ স্ট্যাচু অব মুহাম্মদ’ সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন। মুসলিম সমাজ ও দেশগুলোর অনুরোধের প্রেক্ষিতে ওটা সরানো হয়েছে। এখন ইতিহাসের বাকি নয়জন আইনদাতার ভাস্কর্য রাখা আছে। কোর্টের ভেতরের দেয়ালে ওই দশজনের সঙ্গে তাঁর ভাস্কর্য এখনও আছে কি না জানি না। ওটার ছবি এখনও আছে কি না জানি না।

কোরান-রাসুল (সা.)-সাহাবি-খলিফা-সাম্প্রতিক কাল তো অনেক হল, মধ্যপ্রাচ্যের কী খবর? হাঙ্গামা করার আগে বাংলাদেশের ইমামদের ভেবে দেখা দরকার কেন মধ্যপ্রাচ্যের ইমামেরা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে নন। সৌদি আরবেও বহু ভাস্কর্য আছে। গুগল করুন ‘স্ট্যাচু ইন মুসলিম ওয়ার্ল্ড’ কিংবা ‘স্ট্যাচু ইন সৌদি আরব’– রাস্তার মোড়ে মোড়ে উটের, কবজি থেকে হাতের আঙুলের, মুসলিম বীরদের এবং আরও কত ভাস্কর্য। সেখানকার মওলানারা জানেন কোরান ও রাসুল (সা.) সুস্পষ্টভাবে প্রতিমাকে নিষিদ্ধ করে মূর্তি ও ভাস্কর্যকে বৈধ করেছেন। তাই তাঁরা মুসলিম বিশ্বে অজস্র মূর্তি ও ভাস্কর্যকে অস্বীকৃতি জানাননি।

এবারে কোরান। কোরানে সুস্পষ্ট বলা আছে: (ক.) মূর্তিপূজা শয়তানের কাজ (মায়েদা ৯০) এবং (খ.) “এই মূর্তিগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ?” (আম্বিয়া ৫২)।

অর্থাৎ কোরানের নিষেধ মূর্তিপূজা, উপাসনা-আরাধনা-ইবাদত সম্পর্কে। কারণ, মূর্তি স্রষ্টার অংশীদার অর্থাৎ শরিক হয়ে দাঁড়ায়। এটাই মানুষকে মুশরিক বানায়। তাহলে যে মূর্তিকে আরাধনা ইবাদত করা হয় না, যে মূর্তি সৌন্দর্য্য বাড়ায়, সুসজ্জিত করে সে ব্যাপারে কোরান কী বলে? এখানে আমরা অবাক হয়ে দেখব কোরান সুস্পষ্ট ভাষায় ভাস্কর্যের অনুমতি দেয়। উদ্ধৃতি:

“তারা সোলায়মানের (আ.) ইচ্ছানুযায়ী দূর্গ, ভাস্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত।” (সুরা সাবা, আয়াত ১৩)

নবীজি (সা.) মূর্তি-ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সেটা কোরানের ওই আয়াতের বিরুদ্ধে যেত, সেটা সম্ভব নয়। আরাধনা করলে সেটা হয় প্রতিমা আর না করলে হয় ভাস্কর্য (মূর্তি)। ইসলাম প্রতিমার বিরুদ্ধে, ভাস্কর্য ও মূর্তির বিরুদ্ধে নয়।

আদি থেকে মানুষ স্রষ্টা খুঁজেছে, সূর্য-চন্দ্র থেকে শুরু করে পশু-পাখিকে, এমনকি নিজেরাই মূর্তি বানিয়ে আরাধনা করেছে। যে হযরত মুসা (আ.) মানুষকে সেই একমেবাদ্বিতীয়ম স্রষ্টার দিকে ডেকেছেন তাঁর বিশ্বাসীরা বাছুরের মূর্তির আরাধনা করেছে। যে ঈসা (আ.) মানুষকে সেই একমেবাদ্বিতীয়ম স্রষ্টার দিকে ডেকেছেন তাঁর বিশ্বাসীরা তাঁর তো বটেই, তাঁর মায়েরও (মাতা মেরি) মূর্তি বানিয়ে আরাধনা শুরু করেছে। যে গৌতম বুদ্ধ স্রষ্টার ধারণা ত্যাগ করে কর্মফলের কথা বলেছেন, তাঁর অনুসারীরা তাঁর মূর্তি বানিয়ে আরাধনা শুরু করেছে। এখানেই ইসলামের আপত্তি: ইসলাম আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক বা অংশীদার করার ঘোর বিপক্ষে।

তাই হয়তো অতীত বর্তমানের কিছু ইমাম সরাসরি মূর্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, প্রতিমা ও ভাস্কর্যের পার্থক্য উপেক্ষা করছেন। ইমামেরা প্রতিমার বিরুদ্ধে বলুন অসুবিধা নেই, কিন্তু ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সেটা কোরান-রাসুলের (সা.) বিরুদ্ধে দাঁড়ানো হয় কি না, তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন। কারো দরকার হলে উপরোক্ত সূত্রগুলোর কপি দেওয়া যেতে পারে।

Source: http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/45411