shariakibole.com

হিলা বিয়ে ও তাৎক্ষণিক তালাক

divorce1

“একসাথে তিন-তালাক বা রাগের মাথায় তালাক বৈধ নয়”− বাংলাদেশের শারিয়া-তত্ত্বগুরু শাহ্ আব্দুল হানড়বান – খবর আলোচনা ফোরাম − ৮ ও ১০ জুলাই, ৩৮ মুক্তিসন (২০০৮)।

হিলা বিয়ে জানেন না এমন বাংলাদেশী হয়ত একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলায় এটা কোনকালেই ছিল না কিন্তু এখন গত পনেরো বিশ বছর ধরে এটা খবরের কাগজে প্রায়ই ওঠে। গ্রাম-গঞ্জের মুরুব্বীরা মিলে ফতোয়ার তাৎক্ষণিক আদালতে বিভিনড়ব মামলার শারিয়া-মাফিক বিচার করে রায় ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রীয় বৈধতা না থাকলেও সে-রায় প্রচণ্ড সামাজিক শক্তিতে অপরাধীর ওপরে প্রয়োগ করা হয়। হিলা হল এরই একধরনের শারিয়া-মামলা যাতে কোন কারণে শারিয়া-আদালত কোন দম্পতির বিয়ে বাতিল ঘোষণা করেন। তারপর তাদের আবার বিয়ে দেবার শর্ত হিসেবে স্ত্রীকে অন্য লোকের সাথে বিয়ে ও সহবাসে বাধ্য করেন। দ্বিতীয় স্বামী স্বেচ্ছায় তালাক দিলে তবে সে আবার আগের স্বামীকে বিয়ে করতে পারে। এটা ঘটে প্রধানত স্বামী রাগের মাথায় স্ত্রীকে একসাথে তিনবার তালাক বলে ফেলেছে বলে, তার কথা শোনার সাক্ষী কখনো থাকে, কখনো থাকে না।

কয়েকমাস আগে ভারতে খুব হৈহলা হয়েছিল কারণ এক স্বামী ঘুমের ঘোরে তিনবার তালাক বলে ফেলেছিল। এ-খবর চাউর হলে স্থানীয় মওলানারা তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘোষণা করেন। বাংলাদেশে এমনও হয়েছে যে, কোন নারী প্রম স্বামী থেকে তালাক হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে কয়েকবছর ঘর-সংসার করার পর হঠাৎ মুরুব্বীরা ঘোষণা দিয়েছেন, কোন কারণে আগের তালাক বৈধ নয়। সুতরাং দ্বিতীয় স্বামীর সাথে স্ত্রীর বিয়েও অবৈধ বলে তারা দৈহিক সংসর্গের অপরাধে অপরাধী। অনেক ঘটনার এ-সব দলিল ধরা আছে ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’-এর বইতে ‘ফতোয়া ১৯৯১-১৯৯৫’) এ অপরাধে শারিয়া আইন হল বিবাহিত / বিবাহিতাদের জন্য জনসমক্ষে পাথরের আঘাতে মৃত্যুদণ্ড, অবিবাহিতা / অবিবাহিতাদের জন্য চাবুক।

অবৈধ সম্পর্কের শাস্তির আইনটা কোরাণ-মাফিক কিনা তা অন্য নিবন্ধে দেখিয়েছি। এবারে তাৎক্ষণিক তালাকের কথায় আসা যাক। সুরা বাকারা আয়াত ২২৯ মাফিক তালাক দিতে চাইলে স্বামীকে অন্তত দু’বার ‘তালাক’ উচ্চারণ করতে হয়, তারপর ইদ্দত পার হলে আর উচ্চারণ না করলেও তৃতীয় তালাক প্রয়োগ হয়ে বিয়ে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু সে উচ্চারণ একসাথে তিনবার করলে তালাক পুরো হয় কিনা সেটাই প্রশড়ব। কারণ হিলা বিয়ের শুরুটাই সাধারণত হয় সেটা দিয়ে। তাই চলুন আমরা দেখি এ-ব্যাপারে শারিয়া, রসুল ও কোরাণ কি বলে।

“স্বামী তাহার স্ত্রীকে একই সময়ে একই বাক্যে অথবা পৃক পৃক সময় ও বাক্যে তিন-তালাক দিলে তৎক্ষণাৎ বিবাহবন্ধন ছিনড়ব হইয়া যায় এবং স্বামী তাহাকে ফিরাইয়া লইতে পারে না … স্বামীর সুস্পষ্ট বাক্যে অথবা পরোক্ষ বক্তব্যে অথবা ইশারা-ইঙ্গিতে অথবা লিখিতভাবে প্রদত্ত তালাক সঙ্ঘটিত হইবে … তালাক বলার সময় স্বামীর মনের সংখ্যা বা দেখানো আঙুল দিয়া তালাকের সংখ্যা ধরা যায় … যদি স্বামী বলে তোমাকে তালাক দিলাম, তবে বলিবার সময় স্বামীর মনে যে সংখ্যা থাকে তাহাই বলবৎ হইবে”− সূত্র ১) অর্থাৎ শারিয়া আইনে স্বামী তার স্ত্রীকে তাৎক্ষণিক পুরো তালাক দিতে পারে। কিন্তু রসুলের কিছু হাদিসে আমরা দেখতে পাই উল্টোটা, যেমন :

(ক) “এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন-তালাক একসাথে দিয়েছে শুনে রসুল (দঃ) রাগে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, তোমরা কি আলাহর কিতাবের প্রতি ঠাট্টা করছ? অথচ আমি এখনও তোমাদের মধ্যেই রয়েছি ! … (অনেক ইমামের নাম) এ-হাদিসকে মুসলিম শরিফের সূত্রে সঠিক বলেছেন” − সূত্র ২। (খ) “এক সাহাবি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন-তালাক বলেছে শুনে রসুল (দঃ) বললেন − ‘এই তিন তালাক মিলে হল এক-তালাক। ইচ্ছে হলে এই তালাক বাতিল করতে পার।’ − সূত্র ৩।

এ-ব্যাপারে বিপরীত হাদিসও আছে, যেমন, “একই সঙ্গে তিন-তালাক দিয়ে নিষ্কৃতি লাভ করা যদিও রসুল (সঃ)-এর অসন্তুষ্টির কারণ, যা পূর্ববর্তী বর্ণনায় উলেখ করা হয়েছে, এ-জন্য সমগ্র উম্মত একবাক্যে একে নিকৃষ্ট পন্থা বলে উলেখ করেছে এবং কেউ কেউ নাজায়েযও বলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি কেউ এ পদক্ষেপ নেয়, তবে এর ফলাফলও তাই হবে বৈধ পথে অগ্রসর হলে যা হয়। অর্থাৎ তিন-তালাক হয়ে যাবে, এবং শুধু প্রত্যাহার নয়, বিবাহবন্ধন নবায়নের সুযোগও আর থাকবে না… হুজুর (সঃ)-এর মীমাংসাই এ-ব্যাপারে বড় প্রমাণ যে, তিনি অসন্তুষ্ট হয়েও তিন-তালাক কার্যকরী করেছেন। হাদিস গ্রন্থে অনুরূপ বহু ঘটনার বর্ণনা রয়েছে” − সূত্র ৪।

অর্থাৎ, হাদিসে আমরা একই ব্যাপারে বিপরীত কথা পাচ্ছি, শারিয়া-সমর্থকদের মধ্যেই এ-ব্যাপারে মতভেদ আছে। এটা নূতন কিছু নয়, হাদিসে এ-রকম বহু স্ব- বিরোধীতা আছে। কিন্তু তালাকের মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বিপরীত সুনড়বত আমাদের জন্য যতটা লজ্জার কথা তার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। ভারতের মুসলিম ল’ বোর্ডও ২৬শে ডিসেম্বর ২০০৫ তারিখে বলেছে, “এই হঠাৎ-তালাক হল গুনাহ্।” তাঁরা এও বলেছেন, গুনাহ্ হলেও তাৎক্ষণিক তালাক বৈধ। এইসব উল্টোপাল্টা কথার জন্য সেখানে নারীরা উইমেন মুসলিম ল’ বোর্ড বানিয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি যে-কর্ম গুনাহ্, তার ফলাফল বৈধ হতে পারে না।

কখনো কখনো স্বামী পরে দাবি করে যে, আসলে তালাক দেবার নিয়ত তার ছিল না, ওটা রাগের মাথায় মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে ফল হয় না, কারণ হিসেবে যা বলা আছে তা নবী রসুল তো দূরের কথা কোনো বিবেকবান মানুষকেও শোভা পায় না। “রসুল (সঃ) এরশাদ করেছেন তিনটি বিষয় এমন রয়েছে যে, হাসি-তামাশার মাধ্যমে করা ও বাস্তবে করা দুই-ই সমান। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে তালাক…হাসি-ঠাট্টার ছলে হলেও এবং অন্তরে বিয়ে, তালাক ও তালাক-প্রত্যাহারের ইচ্ছা না থাকলেও মুখের কথা দ্বারা বিয়ে, তালাক এবং প্রত্যাহার বাস্তবায়িত হয়ে যাবে…জবরদস্তি অবস্থায় যদিও সে তালাক দিতে আন্তরিকভাবে সম্মত ছিল না, অক্ষম হয়ে তালাক শব্দ বলে দিয়েছে, তবুও তালাক হয়ে যাবে” − সূত্র ৫) আমরা এটা মানি না। এ-আইনও আছে যে, স্বামী যদি অত্যাচারের চাপে, বা নেশার ঘোরে, বা রোগের কষ্টে অধীর হয়ে, বা হাসি-ঠাট্টায়, নোট লিখে বা টেলিফোনের অ্যান্সারিং মেশিনেও তালাক বলে রাখে তবু তালাক পুরো হয়ে যায় − সূত্র ৬) আমরা এটাও মানি না। ভারতের ও মালয়েশিয়ার শারিয়া আইনে এটা চালু আছে, এ-মামলার দলিলও আমাদের কাছে আছে। এতে বহু নারীর জীবন ধ্বংস হয়।

কিন্তু মুসলিম নারীর জীবন ও সন্তান-সংসার এতটুকু সুতোর ওপর ঝুলে থাকতে পারে না এবং মাতৃজাতিকে এ-ভাবে অপমান পঙ্গু করে কোন জাতি উনড়বতি করতে পারে না। মানুষ তো মানুষ-ই, নবী-রসুল তো নয়। মানুষ রাগের মাথায় ভুল করতেই পারে, তাকে সে ভুল সংশোধনের সুযোগ দিয়ে ভালমানুষ বানানোই ইসলাম। অনেক কঠিন অপরাধের তওবার সুযোগ দিয়েছে ইসলাম, দিয়েছেন রসুল (সঃ). তাই, মুখ ফস্কে দু’টো কথা বের হয়ে গেলে তার আর মাপ নেই, এটা হতে পারে না। নিরপরাধ নারীর জীবন ধ্বংস করে কিতাবের অক্ষর বাঁচানোটা ইসলাম-বিরোধী।

দু’পক্ষের আইনই দেখলাম আমরা। এবার মূল দলিলে আসি। আসলে শারিয়ার এ-আইন বানানো হয়েছে নবীজীর অনেক পরে। এ-কথা বলেছেন কিছু বিশ্ব- বিখ্যাত শারিয়া-সমর্থকরাই। যেমন, “নবীজীর মৃত্যুর বহু পরে তালাকের এক নূতন নিয়ম দেখা যায়। স্বামী একসাথে তিন-তালাক উচ্চারণ করে বা লিখিয়া দেয়। এই তালাকে অনুতাপ বা পুনর্বিবেচনার সুযোগ নাই। অজ্ঞ মুসলমানেরা এইভাবে গুনাহ্ করে। নবীজী তীব্রভাবে ইহাতে বাধা দিয়াছেন” − সূত্র ৭) আরও দেখুন − “নবীজীর সময় থেকে শুরু করে হজরত আবু বকর ও হজরত ওমরের সময় পর্যন্ত একসাথে তিন-তালাক উচ্চারণকে এক-তালাক ধরা হত। কিন্তু যেহেতু লোকে তাড়াতাড়ি ব্যাপারটার ফয়সালা চাইত তাই হজরত ওমর একসাথে তিন-তালাককে বৈধ করেন এবং এই আইন চালু করেন” − সূত্র ৮) এই একই কথা বলেছেন অন্যান্য বহু ইসলামি বিশেষজ্ঞও। ইতিহাসে পাওয়া যায় কেউ তিন-তালাক একসাথে দিলে হজরত ওমর সেই স্বামীকে শাস্তিও দিয়েছেন। কিন্তু তিন-তালাক দেনেওয়ালা স্বামীর কোন শাস্তির আইন কোন শারিয়া

কেতাবেই নেই। কারণ আাইনটা পুরুষের পক্ষে পুরুষেরই বানানো। তাৎক্ষণিক-তালাকে বিপরীত দু’ধরনের হাদিস থাকায় সিদ্ধান্ত নিতে বিশ্ব- মুসলিমের অসুবিধে হয়েছে। হবারই কথা। সহি হাদিসে এমন বৈপরীত্য আছে শত শত। এ-ক্ষেত্রে কি করতে হবে তা ইমাম শাফি’ বলেছেন : “পরস্পর-বিরোধী দুইটি হাদিসের মধ্যে কোন্টি বেশি নির্ভরযোগ্য তাহার বিচার অন্য সুনড়বত দ্বারা বা কোরাণ দ্বারা হইবে” − সূত্র ৯।

এবার তাহলে কোরাণ।

এ-কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, অপরাধ হোক বা না-হোক, সেটা করেছে স্বামী। অথচ হঠাৎ-তালাক হলে নিরপরাধ স্ত্রীর জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। সে হারায় তার স্বামী-সংসার ও সন্তান যদি ছেলের বয়স ৭-বছর ও মেয়ের ৯-বছরের নীচে হয়। কিন্তু একজনের অপরাধে অন্যের শাস্তি হওয়া চরম অন্যায়। সে-জন্যই কোরাণ কি চমৎকার বলেছে − “কেউ, অন্য কাহারো দোষের ভাগী হইবে না” − বাকারা ২৩৪ ; “তাহাদের কর্ম সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হইবে না” − বাকারা ১৪১ ; এবং “একে অপরের কৃতকর্মের জন্য দায়ী হইবে না” − নজম ৩৮. অর্থাৎ স্বামীর অপকর্মের জন্য স্ত্রীকে শাস্তি দেয়া যায় না। হঠাৎ-তালাক যে কতটাই কোরাণ-বিরোধী তা প্রমাণ হয় পদে পদে। নাসুজ অর্থাৎ প্রকাশ্য অশীল কর্ম (অর্থাৎ পরকীয়া) না করা পর্যন্ত স্ত্রীকে অন্য কোন-কারণেই তালাক দেয়া যাবে না এটা কোরাণেরই সুস্পষ্ট নির্দেশ ঃ “যদি তারা কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত না হয় তবে তাদেরকে তাদের গৃহ থেকে বহিষ্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয়, − এগুলো আলাহ’র নির্ধারিত সীমা”− (সুরা ত্বালাক ১). গৃহ থেকে বহিষ্কার করো না মানে তালাক দিও না − এছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

এবারে তালাকের সাক্ষী।

সাধারণত গ্রামগঞ্জের ফতোয়া-আদালত হিলা বিয়েতে স্বামীর তালাক উচ্চারণের সময় কোন সাক্ষী আছে কিনা তার ধার ধারা হয় না। কারণ শারিয়ার আইনটা হল, “বিয়ে ব্যতীত অন্য সব-ব্যাপারে সমাধা করার জন্য সাক্ষী শর্ত নয়” − সূত্র ১০।

আরও দেখুন : “তালাক সঙ্ঘটিত হওয়ার জন্য সাক্ষী শর্ত নহে” − সূত্র ১১।

এ-সব আইন কোরাণ শরীফের ঘোর বিরোধী। দেখুন আল্ কোরাণ সুরা ত্বালাক আয়াত ১ ও ২, আর সুরা বাকারা ২২৯ ও ২২৮ ঃ “তোমরা যখন স্ত্রীদিগকে তালাক দিতে চাও তখন ইদ্দত গণনা করিও। অতঃপর তাহার যখন ইদ্দতকালে পৌঁছে, তখন তাহাদিগকে উপযুক্ত পন্থায় ছাড়িয়া দিবে বা রাখিয়া দিবে এবং তোমাদের মধ্য হইতে দুইজন সাক্ষী রাখিবে…তালাকপ্রাপ্তা নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখিবে তিন হায়েজ পর্যন্ত ।”

তাই তাৎক্ষণিক-তালাক এবং তাৎক্ষণিক-দ্বিতীয় বিয়ে সম্পূর্ণ কোরাণ-বিরোধী।

কোরাণ মোতাবেক কোন নারীকে বিয়েতে বাধ্য করার অধিকার কারো নেই, সেই সময়ে নারীকে এ-অসাধারণ অধিকার দিয়েছে কোরাণ। সে-জন্যই মরক্কো, সিনেগাল, তিউনিসিয়া প্রভৃতি বহু মুসলিম দেশ আইন করে তাৎক্ষণিক-তালাক বেআইনি করেছে − সূত্র ১২. আমাদের মুসলিম আইনের ৭ নম্বর ধারা মোতাবেকও এটা বেআইনি (বিচারপতি গোলাম রব্বানী), তফাৎটা হল ঐসব দেশে আইন ভাঙলে তার “খবর আছে,” আর আমাদের দেশে মা-বোনদের জীবন ইসলামের নামে যে ধ্বংস হয় কোন ইসলামি দলের কানে সে আর্তনাদ সে কানড়বা পৌঁছে বলে মনে হয় না। আমরা এমনই বিবেকহীন হয়ে গেছি।

যে স্ত্রীকে তাৎক্ষণিক-তালাকের মধ্যে পড়তে হয় তার অপমান-অসম্মান, তার ক্ষোভ-দুঃখ, তার মনের অবস্থা কবে আমরা বুঝব ? এ-কোন্ ইসলাম যে নিরপরাধের জীবন এত নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করে ? মায়ের জাতিকে এ-ভাবে অসম্মান ক’রে আমরা কোনদিনই উনড়বতি করতে পারব না। কবে সরকার আইন প্রয়োগ করার মত শক্তিশালী হবে, কবে আমাদের ইসলামি দলগুলো এ-অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, কবে গ্রামেগঞ্জের ইমাম-চেয়ারম্যানেরা এর বিরুদ্ধে শক্ত হয়ে দাঁড়াবে, কবে মাদ্রাসা-শিক্ষকেরা এ-সব তত্ত্ব-তথ্য সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করবেন জানি না। তবে যতদিন তা না হবে ততদিনই আমাদের মা-বোনেরা জাতির চোখের সামনে নিপীড়িতা হতে থাকবেন এবং ততদিনই আমরা পিছিয়ে থাকব।

আমি ইসলামি দলগুলোকে আহ্বান করছি এখনই এই নিষ্ঠুর অনৈসলামিক প্রা বন্ধ করতে। আর মা-বোনদের আহ্বান জানাচ্ছি প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, আমরা সাথে আছি।

আচ্ছা, পুরো তালাকের পর স্বামী-স্ত্রীর পুনর্বিবাহের ওপরে কি কোরাণের অন্য কোনো নির্দেশ আছে যা দিয়ে আমাদের ইমামরা মা-বোনের ওপর এই অপমান আর অত্যাচার বন্ধ করতে পারেন ?

আছে। অবশ্যই আছে।

আবার সুরা বাকারা ২৩০-এর পরপরই আয়াত ২৩২, মওলানা মুহিউদ্দিন খানের অনুবাদ ঃ “আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও এবং তারপর তারাও নির্ধারিত ইদ্দত পূর্ণ করতে থাকে, তখন তাদেরকে পূর্বস্বামীদের সাথে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নিয়মানুযায়ী বিয়ে করতে বাধা দান ক’রো না।”

তাহলে ? মওলানারা কেন এ আয়াতটা প্রয়োগ তো দূরের কথা, উলেখ পর্যন্ত করেন না ? কোন শরিয়া বইতে এ আয়াতের উলেখ নেই কেন ? এ আয়াতের বিষয়ে তাঁর তাফহিমুল কুরাণ-এ তাঁদের নেতা মওলানা মউদুদিও তো না বলে পারেননি − “যখন কোনো স্বামী তাহার স্ত্রীকে তালাক দেয় এবং ইদ্দতের আগে তালাক প্রত্যাহার করে না, সেই দম্পতি যদি চায় তবে তাহাদের পুনর্বিবাহে বাধা দেয়া সেই নারীর আত্মীয়স্বজনদের উচিত নহে” −

http://www.quranenglish.com/tafheem_quran/002-10.htm

স্পষ্টতই, বাধা দেয়া আত্মীয়স্বজনের উচিত নহে হলে কারো জন্যই উচিত নহে।

এবারে আপনাদের একটা প্রশড়ব সামনে দাঁড় করিয়ে শেষ করব। ভেবে দেখুন তো, ওই নির্দেশ দু’টোর কোন্টা মানবাধিকার-সচেতন অগ্রসর সমাজের জন্য চিরকালীন হতে পারে, আর কোন্টা সেই মানবাধিকার-অচেতন পশ্চাৎপদ সমাজের শতাব্দীপ্রাচীন প্রার ওপরে তাৎক্ষণিক নির্দেশ হতে পারে ?

নিয়ত ! নিয়ত !! কোরাণ-রসুলের নারী অধিকার বহু আগেই ডাকাতি হয়ে গেছে ঐ কোরাণ-রসুলের নামেই। কিন্তু নিয়ত যদি ঠিক থাকে তাহলে ঐ কোরাণ-রসুল দিয়েই আমাদের মওলানারা কোরাণ-রসুলের দেয়া নারী অধিকার আবার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন ॥

সূত্র ১. বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৫৭, ধারা ৩৫১; পৃঃ ৪৮৩ ধারা ৩৫১; পৃঃ ৪৭৮ ধারা ৩৪৩; হানাফি আইন পৃঃ ৮১; শাফি’ই আইন পৃঃ ৫৬০ আইন নং এন.৩.৫; মওলানা মুহিউদ্দীনের বাংলা-কোরাণের তফসির পৃঃ ১২৮; মওলানা আশরাফ আলী থানভী’র “দ্বীন কি বাঁতে” পৃঃ ২৫৪ আইন #১৫৩৭, ১৫৩৮, ১৫৪৬ ও ২৫৫৫; ইউরোপিয়ান ফতোয়া কাউন্সিল ও ক্যানাডার মওলানার ফতোয়ায় (টহরঃবফ গঁংষরসং) ওয়েব সাইট ঝঁহহরঢ়ধঃয.পড়স ইত্যাদি।

সূত্র ২. মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত বাংলা-কোরাণের তফসির পৃঃ ১২৭।

সূত্র ৩. বিশ্ব-বিখ্যাত শারিয়া-সমর্থক মওলানা ওয়াহিদুদ্দিনের “ডড়সবহ রহ ওংষধসর ঝযধৎরধ”-তে ফতহুল বারী’র সূত্রে – পৃঃ ১০৮ ও ১০৯।

সূত্র ৪. মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত বাংলা-কোরাণের তফসির পৃঃ ১২৭-১২৯।

সূত্র ৫. মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত বাংলা-কোরাণের পৃঃ ১২৮ ও ৭৫৮।

সূত্র ৬. বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড ধারা ৩৪৭, ৩৪৯; হানাফি আইন, মওলানা আশরাফ থানভি’র বেহেশতি জেওর থেকে শুরু করে মকসুদুল মু’মেনিন পর্যন্ত বহু কেতাব।

সূত্র ৭. বিশ্ব-বিখ্যাত শারিয়াবিদ ডঃ আবদুর রহমান ডোই-এর “শারিয়া দি ইসলামিক ল’ ” − পৃঃ ১৭৯।

সূত্র ৮. বিশ্ব-বিখ্যাত মওলানা ওয়াহিদুদ্দিনের “ডড়সবহ রহ ওংষধসর ঝযধৎরধ” পৃঃ ১১০।

সূত্র ৯. ইমাম শাফি’র বিখ্যাত কেতাব “রিসালা” পৃঃ ১৮২, এটিকে সমস্ত শারিয়াবিজ্ঞানের নর মূল কেতাব বলে ধরা হয়।

সূত্র ১০. মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত বাংলা-কোরাণের তফসির পৃঃ ১২৪।

সূত্র ১১. বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড ধারা ৩৪৪ পৃঃ ৪৭৮।

সূত্র ১২. “উড়পঁসবহঃরহম ডড়সবহ’ং জরমযঃ ঠরড়ষধঃরড়হং নু ঘড়হ-ঝঃধঃব অপঃড়ৎং” নু ডখটগখ পৃঃ ৭০।