shariakibole.com

আইনে আইনে বিরোধ

রিয়া আলার আইন হলে আইন একটাই হতো, চার-পাঁচ রকম হতো না। বিভিনড়ব শারিয়ার মধ্যে পার্থক্য, বিরোধ বা উল্টো আইনও থাকত না। কিন্তু শারিয়ার আইনগুলোতে শত শত মারাত্মক স্ববিরোধীতা আছে। এই পরস্পর-বিরোধীতা মাঝে মাঝেই করুণ ও হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি করে। খুনের অপরাধে মির্জা তাহিরকে পাকিস্তা নের শারিয়া কোর্ট (১) মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ১৯৮৯ সালে, (২) সেটা বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে ১৯৯৪ সালে, (৩) সেটা বদলে নিরপরাধ হিসেবে ছেড়ে দিয়েছে ১৯৯৬ সালে, (৪) আবার ওই একই অপরাধে দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার করে দ্বিতীয়বার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ১৯৯৮ সালে, (৫) তার প্রাণভিক্ষার আবেদন বাতিল করেছে ২০০৩ সালে, এবং (৬) অবশেষে তাকে সম্পূর্ণ মুক্তি দিয়েছে ২০০৬ সালে। বেচারা মির্জা তাহির শারিয়ার এই জগাখিচুড়ির শিকার হয়েছে ১৭ বছর জেলখানায় বন্দী থেকে (খবর বি-বি-সি’র)।

ইমাম শাফি’র বিখ্যাত কেতাব ‘রিসালা’-তে আছে ঃ “ইমাম শাফি ইমাম মালিকের মতামতের সাথে অপ্রত্যাশিতভাবে ভিনড়বমত পোষণ করিতেন” (পৃঃ ১৩)। কিছু উদাহরণ দিচ্ছি ঃ

১। অমুসলিমদের কাছে কোরাণ বিক্রয় নিষিদ্ধ (শাফি’ই আইন নং k.1.2.e)। -আইন লঙ্ঘন করে সুরা ওয়াক্বেয়া, আয়াত ৭৯ − “পাক-পবিত্র ছাড়া আর কেউ একে স্পর্শ করবে না।” এতে মুসলিম-অমুসলিম কিছু বলা হয়নি কারণ কোরাণ তো এসেছেই অমুসলিমদেরকে মুসলিম বানানোর জন্য। ও-আইন প্রয়োগ হলে ভাই গিরিশচন্দ্র কোরাণের প্রম বাংলা অনুবাদ করতে পারতেন না, নবীজীর প্রশংসা করতে পারতেন না ডঃ রাধাকৃষ্ণ, গান্ধিজী, গুরু নানক থেকে শুরু করে ডঃ মরিস বুকাইলি, ডঃ কেনেথ মূর, বার্ট্রাণ্ড রাসেল, মাইকেল হার্ট্জ প্রমুখ অসংখ্য পশ্চিমা দার্শনিক বিশেষজ্ঞগণ। হানাফি আইনে অমুসলিমদের কাছে কোরাণ বিক্রয় বৈধ।

২। যদি দৈহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চারজন বয়স্ক মুসলমানের চাক্ষুষ প্রমাণ না থাকে তাহলে সন্তানধারণ করলে মালিকি আইনে কুমারীকে চাবুক ও বিধবাকে পরকীয়ার অপরাধে প্রস্ত রাঘাতে মৃত্যুদণ্ড হয়। কিন্তু হানাফি আইনে তারা বেকসুর খালাস পায় − (বি-ই-আ ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৯৯ এবং পেনাল ল’ অব্ ইসলাম পৃঃ ৭১)। আলার আইনে এমন হয় না।

৩। অবিবাহিতদের পরকীয়ার জন্য চাবুকের শাস্তি। সেই পরকীয়াতে কন্যা জন্মালে তাকে সেই পিতা হানাফি আইনে বিয়ে করতে পারবে না কিন্তু শাফি’ আইনে পারবে (প্রিন্সিপল্স্ অব্ ইসলামিক জুরি¯প্র“ডেন্স − ডঃ হাশিম কামালি, পৃঃ ২৯।

৪। বিবাহিতা নারী পরকীয়া করলে হানাফি আইনে আজীবন কারাবাস, কিন্তু হাম্বলি, শাফি’ ও মালিকি আইনে মৃত্যুদণ্ড।

৫। হানাফি আইনে নারী-মুরতাদের আজীবন কারাবাস কিন্তু হাম্বলি, শাফি’ ও মালিকি আইনে মৃত্যুদণ্ড।

৬। সাক্ষী থাকুক বা না থাকুক গোপন বিবাহ মালিকি শারিয়ায় অবৈধ, কিন্তু সাক্ষী থাকলে অন্য মজহাবে বৈধ। সূত্র ঃ বিশ্ব-শারিয়াদলের বর্তমান প্রধান নেতা ডঃ ইউসুফ কারজাভি − http://memri.org/bin/articles.cg?Page=archives&Area=ia&ID=IA29106
(Inquiry and Analyses Series – No. 291)

৭। কোনো অবিবাহিত বা অবিবাহিতা পরকীয়ার শাস্তির পর তওবা করলে অন্যান্য মামলায় শাফি’ আইনে তার সাক্ষ্য নেয়া যাবে, কিন্তু হানাফি আইনে নেয়া যাবে না” (“মুসলিম জুরি¯প্র“ডেন্স অ্যাণ্ড কুরাণিক ল’ অফ ক্রাইম্স্” পৃঃ ১৪৬)।

৮। কেউ অন্যায় অপবাদ দিয়ে শাস্তি পাবার পর তওবার পরে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য (শাফি’-মালিকি-হাম্বলি আইন)। কিন্তু হানাফি আইনে নয় − (বি-ই-আ ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৮২৫)।

৯। বোবার সাক্ষ্য স্পষ্ট হলেও হানাফি, শাফি’ ও হাম্বলি আইনে গ্রহণযোগ্য নয়, তবে মালিকি আইনে গ্রহণযোগ্য − (বিধিবদ্ধ ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৬৩)।

১০। হানাফি আইনের সাথে অন্যান্য আইনের বহু বিরোধের অন্যতম কারণ হলো ঃ “হানাফি মতে মুহসান হওয়ার জন্য মুসলমান হওয়া অন্যতম শর্ত, কিন্তু অন্যান্য আইনে তা নয়” (বিধিবদ্ধ ৩য় খণ্ড পৃঃ ৩৭০)।

১১। রাষ্ট্রদ্রোহীতার শাস্তি বাকি সব আইনে মৃত্যুদণ্ড কিন্তু হানাফি আইনে আজীবন কারাগার − ডঃ হাশিম কামালি, পৃঃ ৩০।

১২। ইমাম আবু হানিফা প্রস্তাব করেছিলেন মানুষ মাতৃভাষায় নামাজ পড়–ক। পরে শারিয়াপন্থীদের চাপে তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাহার করেন − ডঃ হাশিম কামালি, পৃঃ ১৯।

১৩। কোনো অমুসলিমকে খুনের অপরাধে কোন মুসলিমের প্রাণদণ্ড হবে না − পেনাল ল’ অব্ ইসলাম, পৃঃ ১৪৯। মওলানা আজিজুল হকের অনুদিত বোখারি ৫ম খণ্ড ৫৩৮ পৃষ্ঠায় আছে হাদিস নং ১০২১ − জিম্মিকে খুন করলে বেহেশ্তের গন্ধও পাবে না। (এ বইটা আপাততঃ হাতের কাছে নেই বলে নিঃসন্দেহ হওয়া গেল না)।

১৪। মৃতের সৎ মা সম্পত্তির অংশ পাবে না, কিন্তু সৎ ভাই-বোন অংশ পাবে −বিধিবদ্ধ ১ম খণ্ড ধারা ৪১৮ ও ৪২৩।

১৫। ঠাট্টায়, নেশার ঘোরে বা চাপের মুখে স্বামী তালাক দিলে হানাফি আইনে বৈধ কিন্তু শাফি’ আইনে অবৈধ − ইসলামিক ল’ − পৃঃ ১৭৪।

১৬। পরস্পরের ব্যাপারে অমুসলিম জিম্মিদের সাক্ষ্য হানাফি আইনে গ্রহণযোগ্য কিন্তু শাফি ও মালিকি আইনে নয় − হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ৩৬৩, বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ২য় খণ্ড আইন নং ৫৭৬।

১৭। স্বামীকে কেউ জোর করে বা ভয় দেখিয়ে স্ত্রী-তালাকে বাধ্য করলে সে তালাক হানাফি আইনে বৈধ কিন্তু মালিকি, শাফি’ ও হাম্বলি আইনে অবৈধ − (বি-আ-ই ১ম খণ্ড ধারা ৩৪৯ − বিশেষণ)।

১৮। স্বামীর মাথা খারাপের রোগ হলে শারিয়া কোর্টে স্ত্রী’র বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করার অধিকার হানাফি আইনে নাই কিন্তু মালিকি, শাফি’ ও হাম্বলি আইনে আছে − (বি-আ-ই ১ম খণ্ড ধারা ৩৬৫ − বিশেষণ)।

১৯। ইশতিহশান নিয়ে হানাফি ও শাফিদের দ্বন্দ্ব সুবিদিত − প্রিন্সিপল্স্ অফ্ ইসলামিক জুরিসপ্র“ডেন্স − ডঃ হাশিম কামালী, পৃঃ ৩৩৯

২০। একই বিষয়ে শারিয়া-ইমামদের প্রবল মতভেদের বহু উদাহরণ দেখুন বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৩৬৬-৩৭২।

এই যে বিরোধ ও বিভ্রান্তি, এটা কেন হচ্ছে ? নারী-বিরোধী পুরুষতন্ত্র ও ক্ষমতার লড়াইয়ের রক্তাক্ত ষড়যন্ত্র ছাড়াও এর আরেক কারণ হল কোরাণের কোন্ আয়াত কখন কিজন্য এসেছিল তা আমরা হয় জানছি না অথবা মানছি না। এ-ব্যাপারে আদি যুগে দু’টো কেতাব লেখা হয়েছিল নবীজীর প্রায় দেড়শ’ বছর পরে, ইবনে হিশাম ইবনে ইশাক ও তারিখ আল্ তাবারি। অন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল আমরা হারিয়েছি বলে সমস্যাটা আরো বেড়েছে। উদ্ধৃতি দিচ্ছি হাদিস আল্ কাফি থেকে ঃ “পয়গম্বর (সাঃ)-এর মৃত্যুর পরে হজরত আলী প্রতিজ্ঞা করিলেন কোরাণের সঙ্কলন না করা পর্যন্ত তিনি ঘরের বাহিরে যাইবেন না। তাঁহার সঙ্কলিত কোরাণে বিভিনড়ব আয়াত সম্বন্ধে স্বয়ং নবীজীর মতামত ছিল। ইহাতে কোন্ আয়াতের পর কোন্ আয়াত আসিয়াছে, কোন্ ঘটনায় কখন কাহার উপর আসিয়াছে ইত্যাদির বিবরণ ছিল। এইগুলি ব্যতীত তাঁহার সঙ্কলনটি আয়াতের দিক দিয়া মুসলিম বিশ্বে প্রচারিত কোরাণের মতই। সঙ্কলনের পরে তিনি শাসকদের সামনে তাহা পেশ করেন। কিন্তু শাসকেরা তাহা গ্রহণ করেন নাই” (হাদিস আল্ কাফি ১ম খণ্ড, আল্ উসুল ২য় পর্ব, অধ্যায় ৪-এর ২, পৃষ্ঠা ১৭৫-১৭৭)।

যেখানে এত স্ববিরোধীতা, যেখানে কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেই, যেখানে কেউ কারো কথা শোনে না, যেখানে বিভিনড়ব দলের মওলানারা পরস্পরকে কাফের-মুনাফেক বলে ঘোষণা করেন, যেখানে কোরাণের আয়াতগুলোর বিভিনড়ব অর্থ সম্ভব, যেখানে কোরাণের নির্দেশের প্রত্যেকটিতে মুসলমান দার্শনিকদের ভেতরেই মতভেদ আছে তা দিয়ে “সর্বসম্মত” আইন বানানো যায় না। আর সর্বসম্মত না হলে কোন আইনই আলা- রসুলের নামে জাতির ঘাড়ে চাপানো যায় না। মানুষের জীবন ও বিশ্বাস কারো খেলার পুতুল নয় ॥