বৃহস্পতিবার।
সেই এসেছিল একবার, মধ্যপ্রাচ্যে, সাড়ে তেরোশো বছর আগে। শত সহস্র বছরে ওই মাত্র একটা দিন, যা সংখ্যা হয়েও সংখ্যা নয়। দলিলের উলেে খ যা সর্বনাশা বৃহস্পতিবার। হাজার বছরের দূরত্ব থেকে এখনো জ্বলন্ত দু’চোখে তাকিয়ে আছে বিশ্বময় মুসলমানের দিকে। সে মহা-অভিশাপের হাত থেকে পরিত্রাণ নেই বিশ্বের দেড়শো কোটি মুসলমানের। এক থেকে দুই, দুই থেকে চার। জীবন্ত কোষের মতো শেষ পর্যন্ত ৭৩ খণ্ডে ছিনড়বভিনড়ব হয়ে গেছে সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর (দঃ)-এর স্বপড়ব − বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব। কি হয়েছিল সেদিন ? কেন এই বৃহস্পতিবারের কথা বলতে গিয়ে কেঁপে গেছে সাহাবীর বুক ? কোন্ সে স্মৃতির বুকফাটা বেদনায় সত্যি সত্যি চোখের পানিতে মরুভূমির পাথর ভিজিয়েছেন ইবনে আব্বাস ? কে, কারা সেই নেপথ্য নায়ক যারা ইতিহাস থেকে কিছু ঘটনা, কিছু নাম, কিছু নির্দেশ মুছে দিতে চেষ্টা করেছে ? না-ঘটা ঘটনা ইতিহাসে ঢুকিয়ে দিয়েছে ?
লোকের আনাগোনা সর্বক্ষণ মসজিদে নবীর সংলগড়ব হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরে। অন্যান্য স্ত্রীদের অনুমতি নিয়ে সেখানে রয়েছেন আলাহ্র হাবিব (বন্ধু). মৃত্যুশয্যায় শায়িত। কত কথা তাঁর মনে তখন। কত কত ঘটনা পেছনের তেষট্টি বছরে ! সেই ছোটবেলায় পশু চরানো, হেরা পাহাড়ের গুহায় সাধনা, সেই বক্ষ বিদারণ, সেই নবুয়ত প্রাপ্তি, সমাজের ব্যঙ্গ বিদ্রƒপ অত্যাচার, সেই অবরোধ। সেই তায়েফ, সেই হিজরত, বদর খন্দক ওহুদ, ইস্পাতকঠিন সাহাবীদের সেই ৯৮টি যুদ্ধ, সেই হোদায়বিয়া, সেই বায়াতে রিজওয়ান। সেই মেরাজ, সেই বিদায় হজ্ব। সেই প্রাণবন্ত প্রশড়ব − ‘আমি কি মহান আলাহ্র বাণী তোমাদেরকে পৌঁছাতে পেরেছি ?’ লক্ষ লক্ষ কণ্ঠের সেই প্রাণবন্ত জবাব − ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, ইয়া রসুলুলাহ !’ পরিতৃপ্ত পয়গম্বরের (দঃ) সেই দু’হাত তুলে প্রার্থনা − ‘ইয়া আলাহ্, তুমি সাক্ষী থাকো।’ সেই সাধনা আজ সফল। প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ইসলামি দর্শন। নিজের রক্তে গড়া সদ্য জন্মানো মেয়েকে বালুতে পুঁতে ফেলা জাতটা আজ জামাতে নামাজ পড়ছে।
একে অন্যের যতড়ব নিচ্ছে। বজ্রনির্ঘোষে ‘আলাহু আকবর’ হুঙ্কারে সংখ্যাগরিষ্ঠ শত্র“র ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পরাজয় শব্দটা অভিধান থেকে মুছে দিয়েছে। কিন্তু তবু কাঁটা বিঁধে থাকে মনে। অলক্ষ্যে ঘনিয়েছে মেঘ। অপেক্ষা করে আছে হিংসার কালনাগ। ওৎ পেতে আছে ক্ষমতার রাজনীতি। পর্দার আড়ালে প্রস্তুত হচ্ছে নটনটি। এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে কালবৈশাখী। তাঁর এত সাধের, এত পরিশ্রমের সৌধ⎯বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব⎯ভেঙ্গেচুরে ছিনড়বভিনড়ব করে ধূলায় মেশাবার জন্য সে বদ্ধপরিকর। কেউ জানে না, শুধু জেনেছেন সেই অমিতজ্ঞানী। বিজয়দীপ্ত ইসলামের সামরিক দুর্ধর্ষ অগ্রগতি সবাই দেখছে। কিন্তু তার ভিত্তিপ্রস্তরে ওৎ পেতে বসে আছে যে কালসাপ, তা নির্ভুল ধরা পড়েছে শুধু তাঁরই অপরিমেয় ধীশক্তিতে। তাই তিনি উদ্বিগড়ব। জীবনের শেষ বছরগুলোতে তাই তিনি ব্যাকুল হয়ে কতবার কতভাবে সুস্পষ্ট আদেশ দিয়েছেন − “খবরদার, নিজেদের মধ্যে মারামারি খুনোখুনি করবে না। মনে রেখো, প্রত্যেক মুসলমান তোমার ভাই। তার রক্ত তোমার জন্য হারাম।”
ফিরে তাকালেন পয়গম্বর (দঃ). ঘরের মধ্যে লোকজন, বিশ্বস্ত সাহাবীরা। আদেশ করলেন লিখবার সাজ সরঞ্জাম নিয়ে আসতে। কিছু একটা মনে হয়েছে তাঁর। মুখের কথা নয়, একেবারে লিখে দিয়ে যেতে চান তিনি। তিনি বললেন − ‘যাতে তোমরা কখনো ভুল পথে না যাও’ (সূত্র দেখুন). সময় আর বেশি নেই। যা-কিছু শেষ নির্দেশ, গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি, তা এর মধ্যেই দিয়ে যেতে হবে মুসলিম উম্মাকে।
–‘না !’
কে ? স্তম্ভিত ঘুরে দাঁড়ালেন ঘরের সাহাবীরা। কে কথা বলছে ! ঐ তো, হযরত ওমর (রাঃ). ইসলামের সর্বোচ্চ সাহাবীদের একজন। প্রবল আপত্তিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি। পয়গম্বর (দঃ)-কে লিখবার সরঞ্জাম দেয়া যাবে না। রোগের প্রকোপের ওপর লেখালেখি করতে গেলে শারীরিকভাবে আরো কষ্ট পাবেন। হজরত ওমর বললেন, ‘লেখালেখির দরকারই বা কি, কোরাণ শরীফই তো আমাদের জন্য যথেষ্ট।’ অবধারিত সমর্থক দাঁড়িয়ে গেলেন কয়েকজন। অবধারিত বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন কয়েকজন। নবী (দঃ) চেয়েছেন, তা-ই যথেষ্ট। কাগজ দিতেই হবে। কষ্ট হবে কি হবে না তা বিচার করার তুমি কে ? শুরু হল চিৎকার, ঝগড়া, হট্টগোল। দিতেই হবে কাগজ। না, দেয়া যাবে না কাগজ। চিৎকার। চিৎকারের বিরুদ্ধে চিৎকার। অসুস্থ পয়গম্বর (দঃ)-এর ঘরে, তাঁর চোখের সামনে। চিন্তা করা যায় ! অমান্য হয়ে গেল পবিত্র কোরআনে আলার সুস্পষ্ট আদেশ − নবী (দঃ)-এর চেয়ে উঁচু গলায় কথা না বলতে। তাহলে সমস্ত কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং ‘তোমরা টেরও পাবে না’ (সুরা আল হুজরাত আয়াত ২)।
এরপরই যে দু’টো ঘটনা ঘটলো তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলমানদের বিশ্বজোড়া
সামাজিক-ধর্মীয় বিবর্তনে এসব ঘটনার প্রভাব অসামান্য। হট্টগোলে বিরক্ত হয়ে নবীজী (দঃ) বললেন সবাইকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন সবাই। কেউ একটিবারও বললেন না যে এ-অবস্থায় তাঁকে ছেড়ে যাওয়া ঠিক নয়। কেন ? লিখিত নির্দেশে এমন কি অসুবিধে ছিল যা ঘর ছেড়ে যাবার বেলায় ছিল না ?
না, কোন জবাব নেই এ প্রশেড়বর।
আর তারপর। কাগজ কলম দেয়া হল না বলে যে নির্দেশ লেখা গেল না, উন্মতের জন্য ‘যাতে তোমরা কোনদিন পথভ্রষ্ট না হও’-এর মত চরম নির্দেশ না দিয়েই কি চলে যাবেন সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর (দঃ) ? তাই কি হয় ? না, হয় না। তাই (সূত্র দেখুন) সেই হট্টগোলের ঘটনার পরে, হুজুর (দঃ) সবাইকে কাছে ডাকলেন। তিনটে নির্দেশ দিলেন। সাহাবী বলছেন নবীজীর নির্দেশ :
- আরব উপদ্বীপ থেকে অমুসলমানদের সরিয়ে দিতে হবে।
-
অন্য দেশের দূত-প্রতিনিধিদের ঠিক তাঁর দেখানো উদাহরণ অনুযায়ী সম্মান ও
আতিথেয়তা দেখাতে হবে। - তিন নম্বরটা মনে নেই। ভুলে গেছি।
কি-ঈ !! ভুলে গেছেন ?? যে পয়গম্বর (দঃ)-এর সামনে শতবার ‘ইয়া রসুলুলাহ্
!
আপনার জন্য আমার পিতামাতা কোরবান’ বলেছেন সেই রসুলুলাহ্ (দঃ)-এর মাত্র তিনটে কথার একটা ভুলে গেছেন ? সাধারণ অবস্থায় নয়, মৃত্যুশয্যার মাত্র তিনটে নির্দেশের একটা ভুলে গেছেন ! যে আপনাদের প্রচণ্ড স্মৃতিশক্তি ইতিহাসে বারবার প্রশংসিত, যে আপনারা শুনে শুনে মুখস্থ রেখেছিলেন বিশাল কোরাণ শরীফ, সেই আপনারা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের শেষ সময়ের মাত্র তিনটে কথার একটি ভুলে গেছেন ?
না, আপনারা ভোলেননি। কোন মানুষের পক্ষে এটা ভোলা সম্ভবই নয়। কোন এক ক্ষমতাধরের স্বার্থে সেটা আপনাদের ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। মুখে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। হুজুর (দঃ)-এর মৃত্যুর পর শত শত বছরের রাজনীতিগুলো, লক্ষ লক্ষ মুসলমানের লাশ, কাবাশরীফের জ্বলন্ত চাদর আর ভাঙ্গা দেয়াল, পর পর তিন খলিফার খুন, কারবালার রক্তস্রোত, রমজান মাসে মুসলমান-মুসলমানের লড়াই-যুদ্ধ, এসবের দিকে তাকালে যে কোন লোক বুঝতে পারবে সত্য ‘ভুলে যাওয়া’ কাকে বলে।
যেমন আপনারা ভুলেছেন সেই তিনশো জনের নাম-ধামের তালিকা (বাংলা বোখারী − আজিজুল হক, ১ম খণ্ড পৃঃ ২৬৭)। ‘আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, বিপর্যয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী যত দলপতি দুনিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত হইবে, যাহার দলে মাত্র তিনশত বা কিছু বেশি লোকও হইবে এরূপ একজন দলপতিকেও রসুলুলাহ্ (দঃ) বাদ দেন নাই। ঐরূপ প্রত্যেকজনের নাম, তাহার পিতার নাম, এবং তাহার গোত্রের নামও রসুলুলাহ্ (দঃ) বয়ান করিয়া গিয়াছেন।’ এমনই অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ তালিকা আমাদের দিয়ে গেলেন
আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ পথ-প্রদর্শক, সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু পয়গম্বর (দঃ). এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ দলিল, চিহ্নিত শত্র“র তালিকা, সেটা কোরাণ শরীফের মতো দলিলবদ্ধ হয়ে পৃথিবীময় ছড়ালো না কেন ? কোন্ সে গদিনসীন শক্তিধরের নাম সে তালিকায় ছিল বলে, তার অসুবিধে হবে বলে সে দলিল লুকিয়ে ফেলা হয়েছে ? বাংলাদেশের জীবনমরণ মুক্তিযুদ্ধে কোন্ কোন্ চেনামুখের নাম সে তালিকায় থাকার সম্ভাবনা ছিল ?
কোনদিন, আর কোনদিনই সে দলিল পাওয়া যাবে না। যেমন পাওয়া যাবে না একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস যদি বাংলাদেশের সরকারি ক্ষমতায় আল্বদর থাকে ১৪০০ বছর। এজিদের বাবা মাবিয়া থেকে শুরু করে হাজার বছর খেলাফতের নামে রাজত্ব করেছে রাজা-বাদশারা। তখনি দরকার হয়েছে ইতিহাস বদলানোর। তাই, কোনদিন পাওয়া যাবে না ইসলামের, মুসলমানের শত্র“ সেই তিনশো মোনাফেকদের তালিকা। আর পাওয়া যাবে না সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল (দঃ)-এর অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ সেই নির্দেশ − ‘যাহাতে কোনদিন তোমরা পথভ্রষ্ট না হও’, সেই সর্বনাশা বৃহস্পতিবারে। যে নির্দেশ লিখতে চেয়েও লিখতে দেওয়া হয়নি। বলে যাওয়ার পরেও ‘ভুলে যাওয়া’ হয়েছে।
কি হতে পারে সেই হারিয়ে যাওয়া রতড়বগুলো ?
প্রধান সূত্র:
সহি বোখারি − বাংলা অনুবাদ − মওলানা আজিজুর হক (১ম খণ্ড পৃঃ ২৬৭)।
সহি বোখারি − ইংরেজী অনুবাদ − মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ মোঃ মহসীন খান (১ম খণ্ড
− হাদিস নং ১১৪; ৪র্থ খণ্ড − হাদিস নং ২৮৮ এবং ৩৯৩)।
অন্যান্য সূত্র :-
আশারা মোবাশশারা − মওলানা গরীবুলাহ ইসলামাবাদী।
মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা − মওলানা আবুল কালাম আজাদ।
সুনড়বত ও বিদয়াত − মওলানা মুহম্মদ আব্দুর রহিম − পৃঃ ৪৭।
ইসলাম ও মুসলমানের ইতিহাসের অন্যান্য বই।